যে ছেলেটি স্বপ্রণোদিত হয়ে ছ্যাঁকা খেয়েছিল

গল্পটার প্রথম চরিত্র আমি নিজে। অর্থাৎ, গল্পের বর্ণনাকারী। শিরোনাম দেখেই বোঝা যায়, এটা একটা ছ্যাঁকা খাবার গল্প। ও হ্যাঁ, প্রেমের ছ্যাঁকাই। সিগারেটের ছ্যাঁকা একটা ছেলে একা একা খেতে পারে। গরম খুন্তির ছ্যাঁকাও একটা মেয়ে একা একা খেতে পারে। কিন্তু, প্রেমের ছ্যাঁকার জন্য একই সাথে একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে দরকার। ধরা যাক, মেয়েটার নাম নীতু।

নীতু আমাদের কলেজের সবচেয়ে কুল, স্মার্ট, ড্যাশিং, নাইস লুকিং এবং ব্লা ব্লা ব্লা জাতীয় অন্যান্য সকল Superlative Adjective দ্বারা বিশেষায়িত মেয়ে। তার ছয় জন স্বীকৃত এবং অজস্র অস্বীকৃত বয়ফ্রেন্ড বিদ্যমান। একটু দাঁড়ান! বয়ফ্রেন্ড মানে কিন্তু, প্রেমিক নয়। বয়ফ্রেন্ড মানে হচ্ছে ছেলে বন্ধু। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে বন্ধু হতেই পারে। তার মানে এই নয় যে, তারা প্রেম করে। বোঝা গেছে ব্যাপারটা?
তো সেই নীতু যখন আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল আমার একেবারে 'ধর ধর! আমারে ধর!' টাইপ অবস্থা। অবশ্য কিঞ্চিত প্যাঁচ খেলে, নীতু যেন আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় সেই ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম। আমার কিঞ্চিত কাব্যপ্রতিভা আছে। তোই সেই সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে একটা কবিতার পেইজে আমার একটা লেখা দিলাম-
বুকটা শুধু ধকধক করে
নামটি মেয়ের নীতু,
'ভালবাসি' বলতে গেলেই
হয়ে যাই আমি ভীতু।
সেই কবিতা এক নূরানি স্বভাবের ফ্রেন্ডের মাধ্যমে নীতুকে পড়ালাম। সেই কবিতা পড়ে, নীতুর অবস্থাও 'ধর ধর! আমারে ধর!' হয়ে গেল। নীতু আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। আমি নিতান্ত অযত্ন অবহেলায় সেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দুই দিন ঝুলিয়ে রেখে তৃতীয় দিনে একসেপ্ট করলাম।

রিকু একসেপ্টানোর পর আরও তিন দিন অতিবাহিত হল। নীতু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল, আমি কখন তাকে নক করি। এটা জানা সত্ত্বেও আমি তাকে নক করলাম না। সবুরে মেওয়া ফলে। আমি তাই মেওয়ার জন্য সবুর করছিলাম। কারণ, একটা ছেলের প্রথমে নক করার অর্থ হচ্ছে ছেলেটা একটা লুল। আর একটা মেয়ের প্রথমে নক করার অর্থ হচ্ছে, মেয়েটা অনেক ফ্রেন্ডলি। নীতু অনেক ফ্রেন্ডলি একটা মেয়ে। তৃতীয় দিনে সে নিজেই আমাকে নক করল। প্রথম দিনেই সে ঝাড়া এক ঘণ্টা আমার কাব্যপ্রতিভার উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করল। তার পর আমি ঝাড়া তিন ঘণ্টা তার রূপের উদ্ভাসিত প্রশংসা করলাম। নীতু আনন্দে গদগদ এবং খুশিতে ডগমগ হয়ে গেল।

এরপর নিয়মিত প্রতিদিন ছয় থেকে সাত ঘণ্টা আমাদের চ্যাট হত। নীতু আবারও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল, কখন আমি তাকে প্রপোজ করব। এবারেও আমি তাকে নিরাশ করে সবুর করলাম। সবুরে মেওয়া ফলে। কিন্তু, এবার মেওয়া ফলতে দেরি করল। প্রথম নক নীতু করেছে। প্রপোজটাও যদি সে করে, তবে তার ভাবে টান পড়বে। আবার তার এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপের দু'সপ্তাহ হতে চলল। এখনও সে পরবর্তী বয়ফ্রেন্ড পায় নি। এটা কোন কথা হল! নীতু সেই শ্রেণির মেয়ে, যে প্রেমিকের থেকে প্রেম করাকে বেশি ভালবাসে।

তাই সে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করল। তার ওয়ালেই সে একটা কবিতা স্ট্যাটাস দিল-
কান পাতলেই শুনি তার ডাক
নামখানি তার পারু,
তাহার তরে বানাই আমি
হৃদয় দিয়ে নাড়ু।
বুঝলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণ চলে এসেছে। তাকে ইনবক্সাইলাম, “কী ব্যাপার? হঠাৎ এত কাব্যিক ভাব! প্রেমে পড়েছ না'কি?”
-হ্যাঁ, পড়েছি তো। তোমার প্রেমে। তুমি জান না?
-জানব না কেন? তোমার হৃদয়ের কোন খবরই তো আমার অজানা নয়।
-তুমি পড় নি?
-জানি না। ইদানীং কোন অনুভূতিকেই আর অনুভব করতে পারি না। হয়তো এরই নাম প্রেম।

ব্যাস! নীতুও ফাঁসল না। আমিও ফাঁসলাম না। মাঝখান থেকে প্রপোজ হয়ে গেল।

ঘড়ি দেখলাম। দুপুর দুইটা সাঁইত্রিশ। মনে মনে কাউন্ট ডাউন শুরু করলাম।

সারাটা দুপুর চ্যাট করলাম। সারাটা বিকেল। সারা সন্ধ্যা। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। মাঝরাত। চুটিয়ে প্রেম করলাম দু'জনে। আমি প্রতি আধ ঘণ্টায় একটা করে কবিতা প্রসব করলাম। এবং নীতুর মুহুমুহু প্রশংসায় ভেসে গেলাম। নীতু পনের মিনিট পর পর তার একটা করে ছবি দিয়ে বলতে লাগল, “এটায় আমাকে একটুও ভাল লাগছে না। তাই না?”
আমি প্রতিবার উত্তরে বলতে লাগলাম, “কী বল! তোমাকে একেবারে অপ্সরীর মত লাগছে।” যা বললাম না, তা হচ্ছে, “একটা অপ্সরীকে ক'জন দেবতার বিছানায় যেতে হয়, তার কোন হিসেব নেই।”

ঘড়ি দেখলাম। রাত একটা বিশ। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। আমি এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। অর্থাৎ, যে ছেলেটা স্বপ্রণোদিত হয়ে ছ্যাঁকা খেয়েছিল, সে আমিই। আমার ছ্যাঁকা খাবার সময় প্রায় হয়ে গেছে।

কথা বলতে বলতে হঠাৎ নীতুর জনৈক প্রাক্তন ছেলে-বন্ধু অর্থাৎ এক্স বয়ফ্রেন্ডের প্রসঙ্গ তুললাম। ভাল মতই এড়িয়ে গেল। ও আমার জাস্ট ফ্রেন্ড ছিল। হ্যান ত্যান সিলিং ফ্যান। এরপর শুরু করলাম ক্রমাগত আক্রমণ। একটার পর একটা ছেলের সাথে ওর সম্পর্কের কথা তুলতে লাগলাম। এবং শেষ তাসটা ছুড়লাম, আমার কাছে থাকা ওর এক বয়ফ্রেন্ডের সাথে ওর চুমু-দৃশ্যের ছবি পাঠিয়ে। কোন রিপ্লাই পেলাম না।

রাত দুইটা ছত্রিশে জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে আমাদের সম্পর্কের কী গতি হচ্ছে?”

রাত দুইটা সাঁইত্রিশে রিপ্লাই পেলাম, “কীসের সম্পর্ক? আমাদের মাঝে কখনও কোন সম্পর্কে ছিল না। একটু ঘনিষ্ঠভাবে মিশলেই প্রেম হয়ে যায় না। বুঝেছ? তোমার মত লুইচ্চা, লম্পট, ক্যারেক্টারলেস ছেলের সাথে করব আমি রিলেশন? ব্লা ব্লা ব্লা... তুমি আর আমি জাস্ট ফ্রেন্ড। ব্লা ব্লা ব্লা...”

আমার তব্দা খাওয়ার কথা ছিল। তব্দা খেলাম না। শেষ মুহূর্তে মেয়েরা সর্বদা এমন রিপ্লাই ই দেয়। সুতরাং, আমি নীতুর বয়ফ্রেন্ড থেকে আমার জাস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম।

সুতরাং, দুপুর বারোটা সাঁইত্রিশে শুরু হয়ে রাত বারোটা সাঁইত্রিশে আমাদের সুদীর্ঘ বারো ঘণ্টার প্রেমের একটা সুন্দর সমাপ্তি ঘটল।

যেহেতু, ছ্যাঁকা খাওয়া শেষ, অনেকে এখানে গল্পের শেষ ভেবে নিতে পারেন। তাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে, গল্প কেবল প্রথমাংশ পার করেছে। দ্বিতীয়াংশ বাকি এখনও।

মানুষ হলেও আমি কিঞ্চিত কচ্ছপ প্রজাতির। নীতুকে এভাবে ইনবক্স ধর্ষণ করেও আমার তখনও আশ মেটেনি। আরও খানিকটা ধর্ষণ করার ইচ্ছে পোষণ করলাম।

ঠিক এই মুহূর্তে গল্পে একটি নতুন চরিত্রের অনুপ্রবেশ ঘটল। মনে করি, তার নাম রাফি। রাফি আমার একটা হ্যাবলা ক্যাবলা টাইপের ধুরন্ধর ফ্রেন্ড। মানে প্রেমের ক্ষেত্রে হ্যাবলা ক্যাবলা। আর বাকি সব ক্ষেত্রে বেশ ধুরন্ধর। বেশ কিছুদিন ধরেই, আমার আশেপাশে ঝুলে আছে এই আশায় যে, আমি তাকে একটা গার্লফ্রেন্ড জোগাড় করে দেব। তাকেই এবার নীতুর সাথে ঝুলিয়ে দিলাম। কিছু হালকা পাতলা ইন্সট্রাকশন দিয়ে নীতুর আইডির লিংক দিয়ে দিলাম।

পরিচয় বন্ধুত্বে এবং বন্ধুত্ব প্রেমে গড়াতে বেশি সময় লাগল না।

কিন্তু, ওই যে বললাম আমি ইন্সট্রাকশন দিয়ে রেখেছি। আমাদের মত তাদের প্রেমও চলছে হালকার ওপর ঝাপসা করে। মানে প্রপোজ হয়ে গেছে। কিন্তু, হয়েছে ফাজলামি মার্কা প্রপোজ কেউ ই বুঝতে পারছে না। কিন্তু, এই ধরনের ফাজলামি মার্কা প্রেম যে কোন সময় সিরিয়াস টাইপের প্রেম হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। সেটা সামলানোর দায়িত্ব আমি নিজে নিলাম।

পরদিন সকাল থেকে আমি নিজের ওয়ালে একটানা হাউকাউ মাউমাউ টাইপের ছ্যাঁক খাওয়া স্ট্যাটাস দিতে শুরু করলাম। নীতুর সাথে ইনবক্সেও এমন ভাব বজায় রাখতে শুরু করলাম যে, এখনও আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। যদি শুধু একবারের জন্য আমার কাছে ফিরে আসে, তবে আমার জীবন ধন্য হবে। সুতরাং, আমার আর রাফির দোটানায় পড়ে নীতু ঠিক করতে পারল না, কার গলায় ঝুলবে।

তার মনে হল, যেহেতু আমার সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে তাই রাফিকে নিয়ে থাকাই যুক্তিযুক্ত। তাই, আমাকে ইনবক্সাইল, “আচ্ছা, আমরা দু'জন তো ভাল বন্ধু হয়ে থাকতে পারি। তাই না?”

আমি দেবদাস মার্কা রিপ্লাই দিলাম, “তুমি আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো। কিন্তু, তুমিই আমার প্রথম প্রেম। এবং শেষ। তোমার আগে পরে কিছু নেই। তোমার কাছে আমি স্রেফ বন্ধু হতে পারি। কিন্তু, আমার কাছে তুমিই আমার প্রথম এবং শেষ ভালবাসা।”

নীতুর মতিগতিতে আবার পরিবর্তন আসল। এবার সে দেখল। রাফির সাথে তার সম্পর্ক চলছে ফাজলামির ওপর। কিন্তু, আমি সিরিয়াস। সুতরাং, আমার সাথেই আবার এগিয়ে যাওয়াই ভাল। আর রাফিও হাতে থাকুক। তাই, রাফিকে স্পষ্ট করে কিছু বলল না। ঝুলিয়েই রাখল। আর আমার সাথে আবার নিয়মিত চ্যাটিং শুরু করল। সম্পর্ক আবার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে শুরু করল।

সপ্তাহ-খানেক এভাবেই চলল। এদিকে রাফি ঝুলতে ঝুলতে অধৈর্য হয়ে উঠল। যখন দেখল, নীতুর থেকে স্পষ্ট করে কোন উত্তর আসছে না, তখন মেজাজ খারাপ করে রাফি নীতুকে ই-ডিভোর্স দিল। অর্থাৎ, ব্লক মারল।

রাতে আড্ডা দিতে মামার চায়ের দোকানে এলাম। ব্লকের কাহিনী শুনলাম। এবং বুঝলাম, চূড়ান্ত আঘাত দেয়ার সময় এসে গেছে। সাথে সাথে নীতুকে নক করলাম, “ঠিক করেছি, এখন থেকে আমরা দু'জন স্রেফ ভাল বন্ধু হয়েই থাকব। কারও ওপর একবার অধিকার ছেড়ে দিয়ে আবার সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে যাবার মত যন্ত্রণাদায়ক কাজ দ্বিতীয়টা নেই।”

নীতুর কোন রিপ্লাই পাই নি। সম্ভবত তার তব্দা খাওয়ার মাত্রাটা এতই বেশি ছিল, সে রিপ্লাই দেয়ার কোন ভাষা খুঁজে পায় নি।

পুনশ্চ: শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নীতু এখনও সিঙ্গেল আছে। কারণ, আমার এই গল্পটা পড়ার পর কলেজের আর কোন ছেলেই আর তার স্বীকৃত বা অস্বীকৃত বয়ফ্রেন্ড হতে আগ্রহী হয় নি।

ইস্টিশন ব্লগ
ফেসবুক নোট
ফেসবুক পেইজ (ভালবাসা এবং কিছু আবেগের গল্প)
ফেসবুক পেইজ (বন্ধু ও ভালবাসা)
ফেসবুক পেইজ (জান নিয়া টানাটানি , প্রেমের নাম দৌড়ানি)
ফেসবুক পেইজ (প্রজাপতি রং মাখা জানালার জাল)
ফেসবুক পেইজ (শেষের বিপরীতে তুমি)
ফেসবুক পেইজ (ভালবাসার সেই কথা গুলো)

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক