অস্পৃশ্য পাপ

সকালবেলা কাকের ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গা না’কি অশুভ। আজকের দিনটা তার মানে ভাল যাবে না। অবশ্য, আজকের দিনটা যে ভাল যাবে না সেটা জানার জন্য কাকের ডাক শুনতে হয় না। এমনিতেও সেটা আমি জানি। একটা ধর্মভিত্তিক দল আজকে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে। দলটার অনুদানে আমাদের মাদ্রাসাটা চলে। অবশ্য অনেক কানাঘুষা চলে যে, এরকম আরও কয়েকটা মাদ্রাসা যে অনুদান পায় সেটা চুরিচামারি করেই না’কি দলটা চলে। যাই হোক, সব ছাত্রকে বলে দেয়া হয়েছে, যারা হরতালে যাবে না তাদের তিনদিন কোন খাবার দেয়া হবে না। সুতরাং, আমরা সবাই একরকম বাধ্য হরতালে যেতে।

ফজরের নামাজ পড়তে এমনিতেই মোরগের সাথে ঘুম থেকে উঠতে হয়। আজকে উঠতে হল আরও আগে। ছ’টার সময় হরতাল শুরু। আগেই গিয়ে রাস্তা দখল করতে হবে। পুলিশগুলো না’কি ঘাড় ত্যাড়া হয়েছে। তারাও আগে চলে আসে। তাই আমাদের আরও আগে যেতে হবে।


রওনা দেবার আগে কলিম স্যার ওরফে কলমি শাক ওরফে লেকচার কলিম একটা লম্বা লেকচার দিল। আল্লাহ’র রাস্তায় যারা শহীদ হবে তাদের মর্যাদা; বিধর্মী খুন করলে তার মর্যাদা আর মুনাফিক হত্যাকারীর মর্যাদা। উনি আবার উদ্ধৃতি দিতে খুব পছন্দ করে। এখানেও দিল:

মহান আল্লা তালা পবিত্র কুরানের সুরা তওবার পাঁচ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, ‘তোমরা মুশরিক কতল কর আর তাদের জন্য ওত পেতে থাক কিন্তু তারা মুসলমান হলে ছেড়ে দাও।

কলমি শাকের একটা কথাও আমাদের কারও বিশ্বাস হয় না। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার ঘরে চলে গেলাম। আস্তে একটা কোরআন শরীফের অনুবাদ নামিয়ে দেখলাম আসলেই এই কথা আছে কি’না? নাহ! কিন্তু, কলমি শাক ঠিক মত বলতে পারেনি। বলা উচিত, ‘বলেনি।’ আর তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, আগের আয়াতে আছে, কাফেররা শত্রুতা না করলে তাদের সাথে ভাল ব্যাবহার করতে হবে আর পরের আয়াত হচ্ছে, যদি মুশরিকরা শত্রুতা না চায় তাহলে তাদের শুধু ছেড়ে দিলেই চলবে না বরং তাদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দিতে হবে।

পড়ে মনটা জুড়িয়ে গেল। আবার বিষিয়েও গেল। কলমিশাকগুলো বেছে বেছে এইসব আয়াতের উদ্ধৃতি দেয় আর মানুষ সেইসব কথা শুনে মানুষ হয়ে মানুষ মারে। ইচ্ছে হল বদটার গালে তিনটা থাপ্পড় মারি। কিন্তু,আমার এখন গিয়ে তার লেকচার শোনা দরকার।

তাড়াতাড়ি ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি সবাই বের হচ্ছে। বেঁচে গেলাম। আর একটুখানি দেরি করে আসলেই আজরাইলের সাথে দেখা করার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
সবার সাথে আমিও বের হলাম। আমাদের গন্তব্য প্রেসক্লাব। পৌঁছানোর সাথে সাথে কয়েকটা দলে সবাই ভাগ হয়ে গেলাম। বাকু আর ফজু আমার জানের দোস্ত। পড়লামও তিনজন একই দলে।

অবশ্য এখনই আলাদা দলের কোন কাজ নেই। প্রথমে মানব-বন্ধন হবে। পুলিশ কিছু না করলে সেখান থেকে মিছিল  বের হবে। সেখানে পুলিশ বাধা দিলেই, ইটপাটকেল মারা শুরু হবে। আমাদের প্রধান কাজ যেভাবেই পুলিশের সাথে মারামারি বাধাতে হবে। পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু হলেই আলাদা দলে ভাগ হয়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ করতে হবে। প্রতিবার না’কি এমই হয়।

খানিকক্ষণ মানব-বন্ধনে দাড়িয়েই মিছিল শুরু হয়ে গেল। সবাই জোর গলায় স্লোগান দিচ্ছে- ইসলাম বিরোধী আইন মানি না মানব না। আমাদের দাবি মানতে হবে। যদিও কি আইন কিসের আইন তার কিছুই জানি না তবুও আমরা তিনজনেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছি আর অধীর আগ্রহে লাঠিচার্জের অপেক্ষা করছি।

একটু পরে বাকু অধৈর্য হয়ে বলল, ‘তোর আইনের গুষ্ঠি কিলাই! লাঠিচার্জ করেনা ক্যান?’

সাথে সাথে আমি জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললাম, ‘জনাব বাকের, আমরা এখানে একটা মহৎ কাজ করতে এসেছি। এখানে এরকম ধৈর্যহীন হলে চলবে না।’
যথাযথ গাম্ভীর্যের সাথে কথাটা বলে, মুখেও কৃত্রিম গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগলাম। অবশ্য বেশিক্ষণ কষ্ট করতে হল না। অতর্কিতে লাঠিপেটা শুরু হওয়ায় মিছিলের লোক অর্ধেক কমে গেছে। পাশে তাকিয়ে দেখি বাকুও নাই ফজুও নাই।

কিছুই করার নেই দেখে আমিও একটা দৌড় দেবার কথা ভাবছিলাম। তখন দেখি একগাদা ইটের টুকরো নিয়ে বাকু আর ফজু আসছে। বুঝতে পারলাম কত বড় বেআক্কেলের মত কাজ করেছি।

একটু পরেই আবার আগের মত লোকজন হয়ে গেল। আগের মত বললে বোধ হয় ভুল হবে। লোকজন বোধ হয় একটু বেশিই হল। আমি অবাক হয়ে ফজলকে বললাম, ‘হ্যাঁ রে ফজু, লোকজন একটু বেশি লাগতেছে না?’

ফজল মাথা চুলকে বলল, ‘পার্টির লোকজন হবে হয়ত। নাইলে ভারা করছে।’

প্রত্যুত্তরটা গ্রহণযোগ্য কি’না ভেবে দেখার সময় পেলাম না। একরকম ক্ষেপে উঠলাম, ‘অ্যা! শালার সপ্তায় সাতদিনের মধ্যে আটদিন খাইতে দেয় কুমড়া আর আলুঘন্ট আবার হুদাহুদি টাকা নষ্ট কইরা গুণ্ডা ভারা করছে। মরার কলমিশাকরে দিয়া যদি আমি আলুঘন্ট না রান্দাইছি...’

‘তাইলে সেইটা আবার আমাগোরই খাইতে হইব’ বাকু আমার কথা শেষ করতে দিল না। একটু থেমে আবার বলল, ‘আর এইসব কামে লোকজন ভারা করতে হয় না। গোলমাল দেখলে পাবলিক এমনিতেও দৌড়ায় আসে। এমনিতে চাইর দিকে এত লোকজন না।’

কথাটা বলার সাথে সাথে তিনজনের বোধোদয় হল। আশেপাশে আর বড়জোর চার কি পাঁচজন লোক বাকি আছে। টিয়ার গ্যাস আর রাবার বুলেটের দৌরাত্ম্যে তারাও বেশ বেশ পেছনে। কাছাকাছি আছে কেবল একপাল পুলিশ। একমাত্র পথ পালানো। কিন্তু, তার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই নিজেদের আবিষ্কার করলাম পুলিশের জীপের ভেতর। ঘাড়ে ধাক্কাটা বোধ হয় বেশি জোরেই দিয়েছে।




জায়গাটা বেশ অন্ধকার। বাল্বগুলো বেশ দুরে দুরে রাখা। প্রায় শ’দুয়েক লোকজন হবে। বেশিরভাগেরই বয়স আমার আশেপাশে। কিছু বড় আর কিছু ছোট। প্রায় সবার গায়ে পাঞ্জাবি-পায়জামা। দেখলেই বোঝা যায় কোন না কোনভাবে মাদ্রাসার সাথে সংশ্লিষ্ট।

বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। অবুঝের মত চারদিকে দেখতেই বাকু আর ফজুকে খুঁজে পেলাম। আমি কিছু বলার আগেই ফজু বলল, ‘ওই পুঁটি মাছ। পুঁটি মাছের জানও তো তোর চাইতে শক্ত। সারাটা জীবন ভইরা কলমি শাক, বেগুন মাছ আর জাপানী বেত মাইরা মাইরা কাবাব বানাইল। আর তুই পুলিশ দেইখাই ভয়ে অজ্ঞান হই গেলি?’

এতক্ষণে বুঝতে পারলাম ঘটনা কি? আমি এখন চোদ্দ শিকের ভেতর। নিজের অনুভূতিটা কেমন হওয়া উচিত বুঝতে পারলাম না। পুলিশের মারের ভয়ে একবার অজ্ঞান হয়ে এখন নিজের প্রতিই লজ্জা লাগছে।

কি করা উচিত বুঝতে না পেরে বাকুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হ্যাঁ রে বাকু, কলমি শাক, বেগুন মাছ আর জাপানী বেতের কি খবর রে? তাগরে ধরছে?’

বেগুন মাছ আর জাপানী বেতও আমাদের স্যার। বেগুন মাছ নামটা কৃতজ্ঞতার স্বারক। বেগুন মাছের কল্যাণে আমাদের মাদ্রাসায় প্রথম ও শেষবারের মত মাছ রান্না করার হয়েছিল। অবশ্য তরকারীতে মাছের সাড়ে সাতগুণ ছিল বেগুন। আর জাপানী বেতের হাতে দিনে ছত্রিশ ঘণ্টা একটা বেত থাকে। জাপানের রাষ্ট্রপতি না’কি তাকে ঐ বেতটা উপহার দিয়েছে। অবশ্য, সোয়া ছয় বছর একটা বেত কিভাবে অক্ষত থাকে এবং একই বেত কিভাবে একেক দিন মোটা-চিকন, লম্বা-খাটো হয়ে আসে সেটা একটা রহস্য। আর এই তিন বদ মিলে আমাদের মাদ্রাসা জীবন সার্থক করেছে। কলমি শাকের মার খেয়ে একবার আমার বা’হাতের হাড় তিন টুকরোর মত হয়েছিল। আর আমার বাপে আমার সাথে দেখা না করে ওই বদরে বলে যায়, পড়াশোনা না করলে আমার আরেকটা হাতও যেন হুজুর তার সেবায় নিয়োজিত করে।

বাকু কোন উত্তর না দেয়ায় এইসব ফালতু চিন্তা করছিলাম। মারের চিন্তা এড়ানোই যার মুখ্য উদ্দেশ্য। এমন সময়ে, একটা ইয়া বড় ভুঁড়ি আমাদের কাছে আসল। ও না! ভুঁড়ির সাথে চারটা হাত-পা আর একটা মাথাও আছে। কিন্তু, ভুঁড়ির জন্য কিছুই দেখা যায় না।

পোশাক দেখে বোঝা গেল সে পুলিশ। এসেই গুনতে শুরু করল। আমাদের সংখ্যা। একশ তিরাশি পর্যন্ত গুনে চলে গেল। তারমানে মোট একশ তিরাশি জন আছে এখানে। কিছুই করার নেই বুঝতে পেরে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এক চোখে ঘুম এসেছে আর এক চোখে এখনও আসেনি। এমন সময় গোটা পঞ্চাশেক পুলিশ গারদে ঢুকল। কপালে কি আছে, বুঝতে খুব বেশি দেরি হল না। ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেও বাইরে সেট প্রকাশ করতে না দেয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগলাম।

পুলিশগুলোকে আসতে দেখে ফজু মন্তব্য করল, ‘বুঝছি, হালাগো চুলকানি উঠছে। চুন না পায়া এখন লাঠি নিয়া আইছে।’

কথাটা বোধ হয় একজন শুনতে পেল। দুর্ভাগ্য তার গায়ে উর্দি চড়ানো। কথাটা সেই পুলিশের কানে যাবার সাথে সাথে সে হিংস্র নেকড়ের মত চিৎকার করে উঠল। অশ্রাব্য কিছু গালি একের পর এক বের হতে লাগল তার মুখ থেকে। তিনজনেই আজকে ফজুর পরিণতি অনুভব করতে পারলাম। কিন্তু, স্রষ্টা বোধ হয় আমাদের থেকেও ভাল বুঝলেন। কিংবা, আমাদের বুঝতে দিলেন না।

ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মত লোকটা ফজুর চুল ধরে একটা হেঁচকা টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। এরপর ওর পিঠের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি মারল। ফজু ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি আর বাকু দু’জনেই কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে গেলাম। যেন অসাড় পাথরের মত নিশ্চল দু’জোড়া চোখ এক অবর্ণনীয় অত্যাচার দেখার অপেক্ষায়। ফজুর চিৎকারগুলো মনে হল, একের পর এক কানে এসে আঘাত করছে, কিন্তু মস্তিষ্কে পৌছাতে পারছে না। শুধু চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্যের অবতারণা ঘটছে।

বেশিক্ষণ তা দেখতে হল না। লাঠির বাড়ি দিতে দিতে বাকুকে বাইরে নিয়ে গেল লোকটা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কেউ তার প্রতিবাদ করার চেষ্টাটুকুও করল না। হয়তো একই পরিণতি প্রাপ্তির ভয়ে।

চিন্তাগুলো খুব বেশিক্ষণ মাথায় স্থান সংকুলান করতে পারল না। বাকি পুলিশগুলো ততক্ষণে আমাদের হাত সিলিংয়ের সাথে ঝোলান রডের সাথে বাধতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশের পায়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। অনেককে লাথি দিয়েও পা থেকে সরানো যাচ্ছে না। বুঝতে পারলাম না, একজন মানুষ তার আত্মসম্মানকে কি করে এভাবে বিসর্জন দিতে পারে।

হঠাৎ প্রচণ্ড গরমে গায়ের চামড়া পুড়ে যেতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম না কি হচ্ছে। বিকট একটা চিৎকার করে উঠলাম। প্রচণ্ড আলোয় চোখ-দু’টো যেন ঝলসে যেতে লাগল। কেয়ামতের দিন না’কি সূর্য মানুষের থেকে আড়াই হাত উপরে থাকবে। আমার কি তবে সেই দিন উপস্থিত? লবণে জড়ানো জোঁকের মত বিবর্ণ, নিস্তব্ধ চোখে দশদিকে তাকাতে লাগলাম। হঠাৎ, ওপরে চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বলছ আমার ওপর। একটা মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু,আমার সামনে দাঁড়ানো পিশাচগুলো তা বুঝতে পারল না।

একের পর এক লাঠির আঘাতে শরীরের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন আত্মসমর্পণ করল। মনে হতে লাগল স্রষ্টা বোধ হয় মানুষকে এতটা জীবনীশক্তি না দিলেও পারতেন। এই যন্ত্রণার থেকে মৃত্যুও শ্রেয়। লাঠির প্রচণ্ড আঘাত থেকে সৌভাগ্যক্রমে শরীরের যে অংশগুলো রক্ষা পাচ্ছে, তাও রক্ষা পাচ্ছে না বাল্বের প্রচণ্ড উত্তাপ থেকে। আহত কুকুরের মত চিৎকার করতে লাগলাম। অসম্ভব জেনেও প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলাম দড়িটা ছিঁড়তে। অসহায়ভাবে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করলাম। বুঝতে পারলাম তখন কেন লোকগুলো এইসব পিশাচের পায়ে হাত দিয়েছিল। জীবন যেখানে সংকটময়, আত্মসম্মান সেখানে তুচ্ছ।




‘এই কি অইল রে? এই নাড়ি তো চলে না। এই মরল না’কি রে?’ অস্পষ্ট কিছু কথা কানে আসতে লাগল। একটু উঠে বসার চেষ্টা করতে লাগলাম। সাথে সাথে যেন শরীরের প্রতিটা পেশী প্রতিবাদ করে উঠল। প্রচণ্ড ব্যথায় উহ শব্দটিও উচ্চারণ করতে কষ্ট হতে লাগল। শুয়ে থেকে আনমনে বললাম, ‘এই ফজু ভোর হইছে?’ উত্তরের জন্য অপেক্ষা করার আগেই মনে পড়ল কাল রাতের সব কথা। ব্যথা অনুভব করার শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে ফেললাম।

হন্যে হয়ে প্রতিটা জায়গায় ফজুকে খুঁজতে লাগলাম। হয়ত মার শেষ করার পর এখানেই কোথায় ফেলে রেখে গেছে। জেলের ছোট্ট জায়গাটাই তেপান্তরের মত বড় মনে হতে লাগল। ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে যেটুকু আলো আসছে সেটা অন্ধকারটাকেই আরও প্রগাড় করে তুলছে।

কানে আবার কিছু কথা আসতে লাগল, ‘আজকে আবার প্যাঁচাল না বাইর করলে তোর শান্তি হইতেছিল না? মাটিচাপা দিবি না বুড়িগঙ্গায়?’ বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর অন্য একটা কণ্ঠস্বর বলতে লাগল, ‘মাটিচাপা দিতে বহুত ঝামেলা। টাইমও লাগব বহুত। তার বদলে পাথ্থর বাইন্দা বুড়িগঙ্গাতেই ফেলি। লাশ পচলেও গন্ধ হবে না।’ কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই অনেকগুলো কণ্ঠস্বর হেসে উঠল। কি ঘটেছে, কি ঘটছে বুঝতে কষ্ট হল না। বুঝতে কষ্ট হল একটা মানুষকে মেরে ফেলে কেউ হাসতে পারে কিভাবে?

একটু পরে সেই ভুঁড়িওয়ালা পুলিশটা আবার এসে বলল, ‘বাকের, হাসান আর ফজল কে রে?’ আমি আর বাকু এগিয়ে গেলাম। দু’জন দেখে আবার প্রশ্ন করল, ‘আরেকটা কই?’ নিশ্চুপ থাকলাম। বাকু বলল, ‘কাল রাতে মারতে মারতে...’ ‘ওই চোপ। চোপ। কথা কম ক।’ বাকু কথা শেষ করার আগেই চিৎকার করে উঠল পুলিশটা। তারপর নিজেকে সামলে বলল, ‘ওইটারে তো কালকে রাতরেই ছাইড়া দিছে। চল তোগো নিতে লোক আইছে।’ নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। বাইরে এসে দেখি মা দাড়িয়ে আছে। অবশ্য আর কাউকে আশাও করিনি।

আমাকে দেখার সাথে সাথে মা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম। বা’হাতটা মেঝে স্পর্শ করার সাথে সাথেই ব্যথায় চিৎকার করে উঠলাম। বুঝলাম, হাতটা আবার ভেঙ্গেছে। কিভাবে যেন ব্যথা অনুভবের শক্তিটুকুও ফিরে পেলাম! প্রচণ্ড যন্ত্রণার মাঝেও যখন নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে তখন আবেগ আপনা থেকেই নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু সেখানে যখন ভুলক্রমে কোন সান্ত্বনার বাণী অনধিকার প্রবেশ করে, তখন আবেগকে শৃঙ্খলিত করা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। মা আমাকে যেন তেমনই এক পরিস্থিতির সামনে এনে দাড় করিয়েছে। এতক্ষণ শরীরের সকল যন্ত্রণা নীরবে সয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু, বাঁধভাঙা কান্না এসে দু’চোখে তখনই ভর করল, যখন মায়ের চোখের দু’ফোটা অশ্রু এসে আমার শরীরে পড়ল। অবুঝ শিশুর মত ফোঁপাতে লাগলাম। মনে হতে লাগল, পৃথিবীতে একমাত্র অভয়ারণ্য হচ্ছে আমার মায়ের আচল।

মোহভঙ্গ হল, যখন পেছন থেকে বাকুর ডাক শুনলাম। মা তাড়াতাড়ি আচলে চোখ মুছে বলল, ‘বাবা বাকু, বেশি লাগছে কোথাও?’ বাকু মুখে এক টুকরো শুকনো হাসি টেনে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল।

যাবার আগে থানার ওসি এক জায়গায় নাম লিখতে বলল। অনেক কষ্ট হল নামটা লিখতে। বাকুর লেখা শেষ হলে ওসি নিজের নামে স্বাক্ষর করার জন্য পকেট থেকে হাতটা বের করল। সাথে সাথে একটা বালা বেরিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। দেখে সম্ভবত চিনতে পারলাম। আরও নিশ্চিত হবার জন্য মায়ের হাতের দিকে তাকালাম। হাতজোড়া খালি দেখেও নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

বাইরে এসে তিনজনেই দাঁড়ালাম। ফজরের আজান দিতে খুব বেশি দেরি আছে বলে মনে হল না। দিনের ব্যস্ত রাস্তাটাকে অদ্ভুত রকমের ফাঁকা লাগছিল। নীরবতা ভেঙ্গে মা বলল, ‘ও আল্লা ভুইলাই তো গেছি! ওই হাসু! ফজু কই?’ কি উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। চুপ থাকলাম। আমাকে নিরুত্তর দেখে বাকু বলল, ‘অরে নাকি আগেই ছাইড়া দিছে।’ ‘অ’ মা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ফজুর কথা মনে পড়তেই আমার মাঝে একটা অসুস্থ চিন্তা জেগে উঠল। কোন রকমে উচ্চারণ করলাম, ‘মা, তুই বাড়ি যা। বাকু আইলে আয়।’ বলেই হাটতে শুরু করলাম। মা পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল, ‘ওই হাসু! কই যাস?’ কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করলাম, ‘জানিনা’ তারপরেই যেন কোন অজানা আশঙ্কায় দৌড়াতে শুরু করলাম। বুড়িগঙ্গার রাস্তা আমার চেনা, শুধু এইটুকুই মাথায় এলো। মাথায় এলো না সেটা একটা নদী। কোথায় খুঁজব আমি ফজুর লাশ?

তবু, প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। পেছনে ফজু চিৎকার করে আমাকে ডাকছে। পেছনে বাকু আমাকে চিৎকার করে ডাকছে। শুনছি কিন্তু অনুভব করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, দিগন্তের লাল আভায় শুধু একটা আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়চ্ছি। পা দু’টো যেন এই সংকটময় মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চাইছে। সমতল রাস্তায় বারবার আছাড় খেয়ে পড়ছি, আবার উঠে দৌড় দিচ্ছি। প্রচণ্ড ব্যথায় সারা শরীর এলিয়ে পড়তে চাইছে। মনে হচ্ছে সারা শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। শরীর থামতে বলছে কিন্তু বিবেক সায় দিচ্ছে না।

প্রায় আধঘণ্টা পরে বুড়িগঙ্গার ধারে পৌঁছলাম। এবার তীর ধরে দৌড়াতে লাগলাম। স্রষ্টা বোধ হয় আমাকে এবার সাহায্য করতে কার্পণ্য করলেন না। কিছুক্ষণ বাদেই পুলিশের একটা জীপ দেখতে পেলাম। চিনতে না পারলেও অনুমান করে নিলাম। যেন এক প্রচণ্ড ঘৃণা আর ক্রোধ এসে আমাকে গ্রাস করল। কি করা উচিত বুঝতে পারলাম না। এক জড়দেহের মত দাড়িয়ে থাকলাম। অল্প কিছুক্ষণ পরেই বাকু এসে পড়ল। আমার আচরণে বেশ অবাক হয়েছে বোঝা গেল। সেটা লুকবার চেষ্টা না করে বলল, ‘তোরে ভুতে পাইছে নি? এইরকম পাগলের মত কইরা কেউ দৌড়ায়?’ কথাগুলো যেন শুনতে পেলাম না, অনুভব করলাম। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর, আড়ষ্ট ঠোটে কোন রকমে সবকিছু খুলে বললাম।

সবকিছু শোনার পর যেন বাকু স্তব্ধ হয়ে গেল। ঘোর কাটতেই আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে গেল ওর মুখ। আঁতকে উঠে বলল, ‘তুই এইখানে আইছস কি করতে?’
কোন রকমে উচ্চারণ করলাম, ‘লাশ নিতে।’
কি কস তুই? তোরে পাগলে পাইছে নি! ও মরছে। এখন যদি পুলিশে জানে আমরাও সেইটা জানছি তাইলে আমগোরও মরা লাগব।
জানি না। আমি কিচ্ছু বুঝি না। কিন্তু, আমি গেলে লাশ নিয়াই যাব।
ওই শ্লা! কে কইছে তোরে লাশ নিতে? আমরা যদি অখন এইখানে মইরা পইড়া থাকি, শকুন ছাড়া কেউ থাকব না লাশ নেওনের লেইগা। কে কইছে তোরে লাশ নিতে?
কইলাম তো, লাশ না নিয়া আমি যাব না।

কথাটা শেষ করেই সামনের দিকে দৌড় দিতে গেলাম। বাকু চেপে ধরল। কিন্তু, মনে হল ও চেপে ধরার আগেই বোধ হয় আমি থেমে গিয়েছিলাম। বিবেক আর যুক্তির বিতর্কে বিবেক নিদারুন ভাবে পরাজিত হয়েছিল। বুঝতে পারলাম কত বড় পাপ আমি করছি, কিন্তু আমার করার কিছুই ছিল না। প্রচণ্ড হতোদ্যম হয়ে নিশ্চল পাথরের মত বসে রইলাম। ভেতর থেকে আমার বিবেক ক্রমশ আমায় ধ্বংস করে দিচ্ছে। বুঝতে পারছি আমি পাপ করছি। নিজেকে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতক পাপী। কিন্তু, সামনে এগিয়ে যাবার মত সাহসটুকু যোগাতে পারলাম না। শুধু শুনতে পেলাম, ওই অনন্ত জলরাশির মাঝ থেকে ফজু আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে।

সহসা চোখের সামনে দু’টো ছায়ামূর্তির আবির্ভাব ঘটল। আবছা আলোতে ক্রমশ এদিকেই আসছে। কিছুটা কাছে আসতেই চিনতে দেরি হল না। মানুষের আবরণের নিচে দু’টো পিশাচ। কিন্তু, তাদের মুখ থেকে মানুষের ভাষাতেই শুনতে পেলাম, ‘কাজটা তাইলে ভালয় ভালয় হইয়া গেল। চল, এখন ফজরের নামাজটা সাইরা আসি।’

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক