ডানপিটে

একটা সময় এই মাঠটাতেই সারাক্ষণ দল বেধে ডানপিটেরা খেলত। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকত সারাটা সকাল, সারাটা দুপুর, সারাটা বিকেল। ডানদিক দিয়ে এগিয়ে চলা রাস্তাটা দিয়ে হেটে গেলে মাদ্রাসাটা সহসা চোখে পড়ে না, আগে চোখে পড়ে মাঠটাই। আর তার মাঝে একদল ডানপিটে। আর একটু ভাল করে দেখলে, দেখা যায় মাঠটার পরেই আখ খেত আর তাকে ঘিরে রাখা খেজুর গাছের সারি। শীতের সময়টা ডানপিটেদের একটা অংশ থাকত এই খেজুর গাছগুলোতে। বিকেলে খেলা শেষ করে, সন্ধ্যের পরে চুপি চুপি একদল উঠে যেত গাছগুলোতে। আর একদল থাকত পাহারায়- কেউ আবার দেখে ফেলে কি’না? তারপর চলত রসের উৎসব। গরমের সময়টাতেও সেই উৎসব চলত। তখন ধ্বংসযজ্ঞ চলত আখ খেতের ওপর।

এখন মাঠটাকে কেমন যেন বিরানভূমি লাগে। শব্দটা অবশ্য শশ্মান হলেই বেশি মানাত। যে শশ্মানে কখনও আগুন জ্বলে না! সারি সারি লাশ যত্রতত্র পড়ে থাকে। আজ সেখানে শকুনের উৎসব চলে। তারা মাঠটাকে পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিয়েছে। নইলে বড্ড গন্ধ ছড়াত লাশগুলো। মাদ্রাসাটায় ক্যাম্প করা খানসেনাদের বেশ অসুবিধা হত তাহলে।

ক্যাম্প এখানে গড়ে উঠেছে আরও একটা। আখ খেতের ভেতর- মুক্তিযোদ্ধাদের। একেবারে খানসেনাদের নাকের ডগায়। কেউ কখনও কল্পনাও করতে পারবে না, এখানে একটা ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। অবশ্য কল্পনাতীত ঘটনাটা এই গ্রামের সবাই জানে। শুধু জানে না হায়েনাগুলো। আর জানে না তাদের পা চাটা কুকুরগুলো।


ডানপিটেগুলোকে অবশ্য এখনও মাঠটার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। সুযোগ পেলে দল বেধে খেলতেও শুরু করে দেয়। যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। একদল মুক্তি সেনা আর একদল খানসেনা। কেউ খানসেনা হতে চায় না। সবাই হবে মুক্তি সেনা। কিন্তু, বড় বড় ডানপিটেগুলো ছোটদের চড়-চাপড় মেরে খানসেনা বানিয়ে দেয়। ছোটগুলো অধোমুখে গিয়ে কিছু আড়ালে গিয়ে দাড়ায়। কখনও আখ আর কখনও খেজুরের ডালগুলো রাইফেল হয়ে যায়। দু’দিক থেকে সমানে গুলি চলে, কিন্তু মারা পড়ে শুধু খানসেনারাই। গুলি যেদিকেই করা হোক না কেন খেলার নিয়ম হচ্ছে খানসেনাকেই মরতে হবে। যেন খানসেনাদের জন্মই হয়েছে বাঙালিদের হাতে মরার জন্য।

খেলাগুলো বেশিরভাগ সময়ই হয় খানসেনা আর রাজাকারদের ঘিরে। মাঠে কোন রাজাকার থাকলেই তার আশেপাশেই খেলা চলে। খেলা চলে খানসেনাদের আশেপাশে। গুলিগুলো তখন শুধু তাদের দিকেই হয়। গুলি ওরাও করে। হাতের টিপ ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য এই সেদিনও একটা খানসেনা কালুকে গুলি করল। কালু মাটিতে পড়ে দু’বার গলাকাটা মুরগির মত তড়পাতে লাগল। তারপর, নিশ্চুপ! নিস্তব্ধ! এই সেদিনও স্রেফ খেয়ালের বশে আরেকটা খানসেনা এলোপাথাড়ি খানিকটা গুলি ছুড়ল। আজমতের ডান হাঁটুতে আর ফজলের ডান পায়ের গোড়ালিতে গুলি লাগল। সবাই পড়িমরি করে দৌড় দিল। তারপর সন্ধ্যের সময় কয়েকজন মিলে এসে ওদের দু’জনকে নিয়ে গেল। আজমত মারা গেল। ফজলের ডান পায়ে পচন ধরেছিল। কেটে বাদ দিতে হয়েছে। তারপরেও এই মাঠে ওদের ফিরে আসতে হয়। কারণ, আরও একটা কাজ চলে তখন। রাজাকারদের কথা শোনা। তারপর সেগুলো পৌঁছে দেয়া মুক্তি-সেনাদের ক্যাম্পে। খবর পৌঁছে দিতে হয় দুরের ক্যাম্পগুলো থেকেও। আবার এখান থেকে খবর নিয়ে যেতে হয় দুরের ক্যাম্পগুলোতে। খেলার জন্য আখ খেতে যেতেই হয়। খানসেনা বা রাজাকার কেউ কিছু মনে করে করে না। হইচই হলে কেউ এক পশলা গুলি ছোড়ে। না লাগলে ভাল! লাগলে আরও ভাল!

ওরা খেলতে এসেছে আজকেও। দু’গ্রাম পরে আইজুর ঘাটে আরেকটা ক্যাম্প আছে। সেখান থেকে খবর নিয়ে যেতে হবে- “এই ক্যাম্পের খানসেনাদের কাছে যথেষ্ট অস্ত্র এসে পড়েছে। দু’এক দিনের মধ্যেই ওরা গ্রামের ভেতরে অভিযান শুরু করবে। তার আগেই, সম্ভব হলে আজকে রাতেই একটা অপারেশন চালাতে হবে।” সাংকেতিক ভাষায় ওরা সেটা একটা কাগজে লিখে রইচের কাছে দিয়েছে। রইচের এটা প্রথমবার। রীতিমত বড়দের হাতেপায়ে ধরে এবারের দায়িত্বটা ও নিয়েছে। মাদ্রাসার কাছ পর্যন্ত এক রকম উড়ে উড়ে এসেছে। তারপর লুকিয়ে দেখা করেছে বড়দের সাথে। ফালু ওকে দেখেই বলল, ‘দে এইবার আমি নিয়া যাই। তুই ছোট মানুষ। পারবি না।’ রইচ সাথে সাথে প্রতিবাদ করল। না পুরোটা সেই করবে।

অগত্যা, শেষ পর্যন্ত একটা ঘুড়ি বানান হল। তার মাঝে বাঁশের কঞ্চির সাথে বেধে দেয়া হল কাগজটা। কারণ রইচের পক্ষেই কেবল এভাবে কাগজটা পৌঁছে দেয়া সম্ভব। এ এলাকায় ঘুড়ি ওড়ানোর দক্ষতায় ওর ধারে কাছেও কেউ নেই। আগের বছরগুলোতে প্রতি শীতে অঘোষিত ঘুড়ি উৎসব চলত। আর রইচ একটার পর একটা করে সবার ঘুড়ি কেটে দিত। বড় ডানপিটেগুলো সাগু আর কাচের টুকরো গুড়ো একসাথে জ্বাল দিয়ে সুতোয় লাগিয়ে নিত। কিন্তু, তারপরেও রইচের সাধারণ সুতোর কাছে সেগুলো হেরে যেত। আজকে অবশ্য রইচের কাজ ভিন্ন। আজকে নিজের ঘুড়িটাকেই ওর কাটতে দিতে হবে। এমন জায়গায় নিয়ে সুতোটা ছিঁড়ে দিতে হবে যেন সেটা ঠিক মুক্তি-সেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে পড়ে।

রইচ একটু একটু করে সুতো ছাড়তে শুরু করল। ঘুড়িটা উঠতে শুরু করেছে। কিন্তু, বাতাসটা বড্ড বেশি এলোমেলো। দক্ষ হাতেও ঘুড়ি পোষ মানতে চাইছে না। একটু পর পর এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে। রইচের বুকটাও দুরু দুরু করছে। মাঠটা পার হয়ে ঘুড়িটা আখ খেতের কিনারা স্পর্শ করল। রইচ ঘুড়িটাকে খানিকটা নিচে নামিয়ে সুতো ছিঁড়ে দিল। বাকিটার দায়িত্ব বাতাসের- ঘুড়িটাকে ভাসিয়ে নিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলা। ঘুড়িটা ক্রমশ ধীরে কখনওবা দ্রুত এগিয়ে যেতে শুরু করল। রইচের বুকটা যেন কাঁপছে। বাকিদেরও। যদি বাতাস পড়ে যায়, কিংবা উল্টো বইতে শুরু করে? না রইচ এখন সেসব ভাবতে চাইছে না। বাতাস তার অনেক দিনের বন্ধু। তাকে সে খুব ভাল ভাবে চেনে। তার প্রতিটি গতিবিধি তার চেনা। ঘুড়ির মাঝিকে বাতাসের সাথে বন্ধুত্ব করতে হয়। তাকে চিনতে হয় খুব ভাল করে। তারপরেও রইচের বুক কাঁপতে লাগল।

ঘুড়িটা প্রায় চলে গেছে; এই আর একটু। হঠাৎ, ঘুড়িটা একটা পাক খেল। রইচ ভয়ে চিৎকার দিতে চাইল। রতন ওর মুখ চেপে ধরল। ঘুড়িটা এখন এক জায়গাতেই ঘুরছে। তারপর, হঠাৎ ঘুড়িটা উল্টো দিকে ঘুরে মাঠের দিকে এগোতে লাগল। সবাই সাথে সাথে উল্টো দিকে দৌড় দিল। রইচ অথর্বের মত পড়ে রইল। ওর মাথা কাজ করছে না। ঘুড়িটা এসে মাঠের মাঝখানে পড়ল।
রইচের মাথায় এখন একটা ভয়ঙ্কর চিন্তা কাজ করছে। রইচের ইচ্ছে করছে, মাঠের মাঝে গিয়ে ঘুড়িটা নিয়ে আসতে। ওর মনটা এখন দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। ভয় আর সাহসে মাঝে এখনও ভয়টাই বেশি। রইচ চেষ্টা করছে সাহসটাকে বাড়াতে। রইচ চোখ বন্ধ করল। কালুর কথা মনে করল। আজমতের কথা মনে করল। ওর মনে পড়ল ফজলের কথা।

রইচ উঠে দাঁড়াল। এক পা দু’পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পদক্ষেপ ভয় আর শঙ্কায় আচ্ছন্ন। প্রতি মুহূর্তে ওর ইচ্ছে করছে ছুটে একটা দৌড় দিতে। অনেক কষ্টে পা দুটোকে শান্ত রাখল। ঘুড়িটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বুক থেকে একটা আটকে থাকা নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল। ঘুড়িটাকে তুলে নিলো। তারপর এক ছুট দেবার জন্য উল্টো ঘুরল। মুহূর্তে ওর শরীরের সমস্ত রক্ত জমে হিম হয়ে গেল। ওর পেছনে আজর মোল্লা দাঁড়ানো। এই এলাকার শান্তি কমিটির প্রধান কাসেম তালুকদারের ডানহাত। হাতে একটা বেয়নেট। রইচ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর ডান হাতে বেয়নেট ঢুকিয়ে দিল। হাত এফোঁড় ওফোঁড় করে বেয়নেট বেরিয়ে গেল। হাত থেকে ঘুড়িটা পড়ে গেল। রইচ সাথে সাথে একটা দৌড় দিল। কিন্তু, দু’পা এগিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। ডান হাতের যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। মোল্লা সাথে সাথে গিয়ে ওকে ধরল। তারপর গিয়ে ঘুড়িটা তুলল। সাথে বাধা কাগজটা দেখল। মানে না বুঝলেও ‘এটা কি’ তা বুঝতে সমস্যা হল না। লোভে ওর দুটো চোখ চকচক করলে। কিসের লোভে? টাকা? না’কি নারী?



জানালাগুলো খোলা থাকলে রুমটা রইচের পরিচিতই মনে হত। পরিচিতই মনে হত যদি জানালার ফাঁক গলে আবছা আলো এসে, এমন একটা ভুতুড়ে আবছায়ার সৃষ্টি না করত। এখানে সে বহুবার চিৎকার করে কোরআন পড়েছে। রইচ কতক্ষণ ধরে এখানে পড়ে আছে সে জানে না। কয়েক মুহূর্ত হতে পারে। কয়েক যুগও হতে পারে। কিংবা, সময় শূন্য। হয়তো এখনই সে আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠবে। মনে মনে ভাববে, বাব্বাহ! কি ভয়ানক দুঃস্বপ্ন ছিল। বুকে দু’বার থুথু দেবে। রইচ প্রাণপণে চাইছে যেন এটা একটা দুঃস্বপ্ন হয়। আচ্ছা, এটা কি আসলেই একটা দুঃস্বপ্ন? না’কি দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ বাস্তব!

অকস্মাৎ দরজা খুলে গেল। দরজা খুলে খাকি উর্দির দু’জন ঢুকল। তার পেছনে কাসেম তালুকদার। তার পেছনে আজর মোল্লা। মুহূর্তে রইচের শরীরের সমস্ত রক্ত জমে হিম হয়ে এলো।

খানসেনা কোন ভণিতার ধার ধারল না। সরাসরি, ওর মুখের সামনে কাগজের টুকরোটা ধরে বলল, ‘ইয়ে ক্যায়া হ্যায়?’
রইচের প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছে বলে দিতে। বলতে চাইল। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হল না। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবসময় তার নির্দেশ মেনে চলে না। মনে হয় তাদেরও বোধশক্তি আছে। তারাও বোঝে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে। কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায়। আর একটা বিবেকের অধিকারী হয়েও মানুষ বোঝে না।

রইচ কিছু বলতে পারল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। খানসেনাটা উঠে দাঁড়াল। কাসেম তালুকদারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাব বোলেগা, মুঝে বুলানা।’ কাসেম তালুকদার আজ্ঞাবহ দাসের মত ঘাড় নুইয়ে সম্মতি জানাল।

কাসেম তালুকদার আজর মোল্লার কানে কানে কি যেন বলল। আজর মোল্লা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খানিক পরে তাকে ফিরতে দেখে রইচ শিউরে উঠল; তার হাত ভর্তি খেজুরের কাঁটা। নিজের পরিণতি বুঝতে কষ্ট হল না রইচের। অনেক চেষ্টা করেও ‘আয়াতুল কুরসি’টা মনে করতে পারল না। ওর মাথা এখন কাজ করছে না।

কাসেম তালুকদার ওর সামনে এসে বসল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কথাগুলো গুছিয়ে নিলো। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তুই এখনও বাইচ্চা আছস ক্যান তুই জানোস?’

রইচ মাথা দোলাল; সে জানে না।

তালুকদার তাকে কাগজটা দেখিয়ে বলল, ‘এইটার লেইগা। এইটার মানে আমরা না জানন পর্যন্ত তুই বাইচ্চা আছস। আমগোরে তুই এইটার মানে কবি?’

রইচ মাথা দোলাল; সে বলবে না।

তালুকদার হাসল। পিশাচের হাসি। বলল, ‘তুই কি মনে করছস? যতক্ষণ তুই আমগোরে এইটার মানে না কবি ততক্ষণ তুই বাইচ্চা থাকবি? হ, থাকবি। তয় আমার মনে অয় অই বাইচ্চা থাকার থাইকা একটু পরে তুই মইরা যাইতেই বেশি খুশি অইবি!’
রইচ কিছু বলল না। ফ্যালফ্যাল করে শুধু তালুকদারের দিকে তাকিয়ে থাকল।

তালুকদার পিছনে ফিরে আজর মোল্লার দিকে তাকাল। আজর মোল্লা কাঁটাগুলো এনে তালুকদারের পাশে রাখল। তালুকদার একটা কাঁটা তুলে নিয়ে ভালভাবে পরখ করল। তারপর, রইচের ডানহাতের তালু ধরে মেঝের ওপর চেপে ধরল। রইচের সারা শরীর তখন থরথর করে কাঁপছে। তালুকদার খুব নিখুঁতভাবে কাঁটাটা হাতের তালুর মাঝখানে চেপে ধরল। রইচ ‘আল্লা গো’ বলে একটা চিৎকার দিয়ে কোরবানির গরুর মত তড়পাতে লাগল। তালুকদার শক্ত করে হাত ধরে রাখল। খানিক পরে কাঁটাটা এফোঁড় ওফোঁড় করে বের করে নিয়ে এলো। রইচের তালু থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। তালুকদার তাকে ধরে সোজা করে বসাল। রইচের মুখ ভয়ে এবং ততোধিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠছে।

তালুকদার তাকে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘বলবি? বললে তাতরি ক’।

রইচের কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

তালুকদার তাকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে একটা চড় মারল। রইচ ছিটকে পড়ল মেঝেতে। অস্ফুট গোঙ্গানির শব্দ আসতে লাগল মুখ থেকে। তালুকদার আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে! বলবি?’

রইচ অনেক কষ্টে মাথা দোলাল; সে বলবে না।

তালুকদার অবাক হল না। যুদ্ধের শুরুর দিকে অবাক হত। এখন আর হয় না। যদিও সে এখনও বুঝতে পারে না, কিভাবে একটা মানুষকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার আত্মাটাকে বেরোবার জায়গা করে দিলেও তার মুখ থেকে একটা শব্দ বেরোবার জায়গা হয় না। সে এখনও বুঝতে পারে না, প্লায়ার্স দিয়ে একটা একটা করে নখ উপড়ানোর কষ্টকে সহ্য করে কেউ কিভাবে চুপ থাকে। সে এখনও বুঝতে পারে না, সাড়াশি দিয়ে যখন কোন মুক্তিযোদ্ধার চোখ উপড়ে নেয়া হয় তখন সে কিভাবে সেই যন্ত্রণা সহ্য করে একটা তথ্যও ফাঁস করে না। সে এখনও বুঝতে পারে না, কিভাবে প্রতি মুহূর্তের শত প্রতিকূলতা, শত বাধা, শত মৃত্যুর আহ্বান স্বত্বেও মুক্তি-সেনারা বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়। সেই কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু, সে এখন আর এসবে অবাক হয় না।
সে অপেক্ষাকৃত আরেকটা বড় কাঁটা তুলে নিলো। তারপর রইচের বা’হাতটা ধরল। হাতের তালু দিয়ে কাঁটাটা ঢুকিয়ে দিয়ে কনুইয়ের কাছ দিয়ে বের করে আনল। রইচের সমস্ত দেহ ধনুষ্টংকারের রোগীর মত বাঁকা হয়ে গেল। রইচ চিৎকার করে বলল, ‘মেরে ফেল। তোর পায়ে পড়ি, আমাকে মেরে ফেল। আমি তোর পায়ে পড়ি। মেরে ফেল আমাকে’। রইচ মেঝেতে এলিয়ে পড়ল। বিন্দুমাত্র নড়ার শক্তি তার দেহে অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।

তালুকদার আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘বলবি? বললেই তোকে মেরে ফেলব। স্রেফ একটা বুলেট দিয়েই। আর কোন যন্ত্রণা থাকবে না।’

রইচ এক পলক তাকাল তার দিকে। তারপর হৃদয়ের সমস্ত ঘৃণা একত্রিত করে, এক দলা থুথু ছুড়ে মারল তালুকদারের মুখে।
রাগে চিৎকার করে উঠল তালুকদার। শরীরে সর্বশক্তি একত্রিত করে রইচের পেটে একটা লাথি মারল। রইচের দেহটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে আবার মেঝেতে আছড়ে পড়ল। ঘরের আর বাকি সবাই স্তব্ধ। এইটুকু পুঁচকে ছেলের এতটা সাহস হয় কোথা থেকে?

তালুকদার বড় বড় দু’টো নিঃশ্বাস নিলো নিজেকে শান্ত করার জন্য। তারপর আজর মোল্লার কাছে গিয়ে বলল, ‘তোরা এইটারে আধ ঘণ্টা দেখ। আমি এশার নামাজটা পইড়া আসতেছি।’ আজর মোল্লা উৎফুল্ল ভাবে মাথা নোয়াল। এতক্ষণ পর সে রইচকে যন্ত্রণা দেবার সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত উৎফুল্ল বোধ করছে।

আজর মোল্লা তালুকদারে মত এতবার জিজ্ঞাসার ধার ধারল না। নিয়ে আসা কাঁটাগুলো এক এক করে রইচের সারা দেহে গেঁথে দিল। মাথা থেকে পা অবধি। মৃতপ্রায় রইচ শুধু তড়পাতে লাগল। যন্ত্রণার শেষ ধাপ। দোজখও এতটা যন্ত্রণার কি’না সন্দেহ! তাতেও আজর মোল্লা ক্ষান্ত হল না। দু’টো কাঁটা দিয়ে রইচের চোখ দুটো তুলে নিলো। রইচ একটা শব্দও করল না। সে শুধুই এখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।

এমন সময় তালুকদার ফিরে এলো। সারা শরীরে কাঁটা গেথে দেয়া রইচকে দেখে তার বিন্দুমাত্র বিকৃতি ঘটল না। শান্ত কণ্ঠে রইচের কাছে গিয়ে বলল, ‘শেষ বারের মত জিগাইতেছি। কাগজটায় কি ল্যাখা আছে কবি?’

রইচ শেষবারের মত কিছু বলার জন্য সারা শরীর থেকে শক্তি জমা করল। তারপর প্রাণপণে উচ্চারণ করল দু’টো শব্দ, ‘জয় বাংলা’।

তালুকদার চিৎকার করে উঠল। ‘তোর এত বড় সাহস? এত সাহস তোর! জন্মের মত তোর কথা বলা আমি বন্ধ করতেছি।’
তালুকদার আর একটা কাঁটা তুলে নিলো। রইচের মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে গলা দিয়ে বের করে আনল। রইচের এতটুকু যন্ত্রণা হল না। এতটুকু কষ্ট হল না। রইচের দেহ তখন সকল বোধের অগম্য। তালুকদার কপালের ঘাম মুছল। স্বগতোক্তি করল, ‘শালার মুক্তিগুলান জীবনে মানুষ অইব না। এগো কি আল্লায় ব্যথা লাগার শক্তি দ্যায় নাই?’ একটু থেমে আবার বলল, ‘আজর, এইটারে মাঠে ফালায়া আয়। একটু দুরে ফেলাইস। আজ-কাইল বেশি গন্ধ ছড়াইতেছে।’

আজর মোল্লা আর একজন নিয়ে এসে রইচের মৃতদেহ ধরল। হঠাৎ, একটা গুলির শব্দ শোনা গেল। কি ঘটছে বুঝতে কারও কোন অসুবিধা হল না। ঘরের এক কোণায় সবাই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। কেউ টু শব্দটা কমে না। আধ ঘণ্টা পর গোলাগুলির শব্দ খানিকটা কমে আসে। শঙ্কা কমে যাবার কথা ছিল, কিন্তু সেটা আরও বেড়ে যায়। খানিক পর তাদের আশঙ্কা সত্যি করে সে ঘরে প্রবেশ করে দু’জন মুক্তি সেনা। পাশে পড়ে থাকতে দেখে শরশয্যায় শায়িত রইচের বীভৎস লাশ। এরপর দেখে পাশে থাকা শান্তি কমিটির সদস্যদের। তাদের কিছু বলে দিতে হয় না। রাইফেলের সবগুলো গুলি দিয়ে সবাইকে ঝাঁজরা করে দেয় এক হিংস্র প্রতিহিংসায়।

তারপর রইচের দেহ তুলে নেয় সেখান থেকে। একটা ডানপিটের পাশে বিশ্বাসঘাতকদের লাশ মানায় না।

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক