সে নেই!

তার সাথে আমার পরিচয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। শিখা চিরন্তনের দু'পাশে যে দু'টো উঁচু ঢিবির মত 'কিছু একটা' আছে, সেখানে বসে ছিলাম তখন আমি। 

তার সাথে দেখা হওয়াটা খানিকটা অদ্ভুত! টিলার পাশে বারো ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর বসে আমি তখন পা নাচাচ্ছি। হাতে ছিল একটা জয়েন্ট। চার শলার গাঁজা একটাতে। সুগার ছাড়া। 'সেইরকম' মাদকতা। একা একা এই জিনিসের সুযোগ প্রতিদিন হয় না। আজকে সবাই আসার আগেই একটা শেষ করি। সাধারণত এমন সুযোগ পাওয়া যায় না। আমি আনমনে মাথা দোলাচ্ছি। কানে এয়ারফোনে Pinik Floyd এর High Hopes বাজছে। বাতাসটা যেন দুলছে। অনেক দূরে কোথাও থেকে যেন একটা গির্জার ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। বাতাসটা তার সাথে সাথে উঁচু নিচু হয়ে ঢেউয়ের মত এগিয়ে আসছে। ইটের ভাটার মত ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে, আমিও তার সাথে পা দোলাচ্ছি। হঠাৎ পা থেকে স্যান্ডেল খুলে পড়ে গেল। পায়ে স্যান্ডেল নেই বুঝতে পেরে আমি নিচে তাকাতে না তাকাতেই নারীকণ্ঠের তীব্র চিৎকার ভেসে এলো - “ওই! এই স্যান্ডেল কোন হারামি, বান্দর, চামচিকার বাচ্চা, ইন্দুরের ছাও, টিকটিকির আণ্ডা, তেলাপোকার বিষ্ঠা...”
সাথে সাথে স্যান্ডেলের আশা ত্যাগ করলাম। পরিস্থিতি যা বুঝলাম তাতে এই মুহূর্তে স্যান্ডেল আনতে নিচে নামা মানে সাক্ষাৎ নিজের প্রাণটা আজরাইলের হাতে তুলে দিয়ে আসা। এই ছবির হাঁটে আসা সব মেয়েই কি এমন দজ্জাল হয়? না'কি সব দজ্জাল মেয়েরাই ছবির হাঁটে আসে। ধুরর! দজ্জাল তো পুরুষ মানুষ। দজ্জালের স্ত্রী লিঙ্গ কী হবে? দজ্জালনী? ধুরর! দজ্জাল তো আরবি শব্দ। সেটার স্ত্রী লিংক কী হবে? দজ্জালা? জানি নাহ! এখন এই দজ্জালার হাত থেকে বাঁচি। আস্তে উঠে সরে অন্য দিকে চলে গেলাম। 

শেষ রক্ষা হল না! সরে বসে আরেকটা টান দিতে যাব, ঠিক তখনই আমার ঠিক সামনে শুরু হল - “হারামজাদা! মস্তান হইছিস? মেয়েদের দেখলে আর কোন হুশ থাকে না, শালার বাচ্চা শালা? বান্দরের পুত, ঘরে মা-বোন নাই? কথা বলিস না কেন হারামি? চামচিকার বাচ্চা, ইন্দুরের ছাও! আমি চাইলে তোরে এখুনি এইখানে গাইরা ফেলতে পারি, তুই জানিস? হারামজাদা! তুই...”

আমি ধীরে সুস্থে আরেকটা বড় টান দিয়ে ঘাসের ওপর সন্তর্পণে গাঁজার শলাটা রাখলাম যেন আগুন না পড়ে যায়। কান থেকে হেডফোন খুলে পেছনে ঝুলিয়ে দিলাম। ব্যাগের পকেট থেকে কাঁচিটা বের করলাম। এখন এই মেয়েকে যদি সামনে গিয়ে একবার বলি, “ওই মাগী, আর একটা কথা বলবি তো এই কাঁচি দিয়া চোখ দুইটা গাইল্লা দিমু” তাহলেই দৌড়ে পালানোর জায়গা পাবে না। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেও দিতে পারে। এদের সামনে চুপ থাকলেই এরা বেশি বাড়ে। উঠতে যেতেই মাথাটা প্রচণ্ড ভারী মনে হল। মাদকতাটা ভর করতে শুরু করেছিল। আর এখুনি এই জ্বালা! ধুরর! 

উঠে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে যাব, “ওই মাগী...” হঠাৎ কেন যেন আমার মুখ দিয়ে বের হল “পথ আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন কাহার আঁখি? আজকে নিলো ডাকি।” 

মেয়েটা চমকে আমার দিকে তাকাল। এমন কোন কথা সে ঘুণাক্ষরেও আশা করে নি। আশা করি নি আমি নিজেই। মুখ দিয়ে গালির বদলে জীবনানন্দের কবিতা বেরিয়ে এলো কেন কে জানে? পিনিকে কি একটু বেশিই আছি? নিজেই অবাক হয়ে গেলাম প্রচণ্ড। আবার তার চোখ দু'টোর দিকে তাকালাম। এ দু'টো চোখ দেখেই কি জীবননান্দ মানবীর চোখকে পাখির নীড়ের সাথে তুলনা করেছিলেন? হয়তো! খুব বেশি অবিশ্বাস্য মনে হল না কথাটা। প্রচণ্ড রাগে কিংবা মৃদু বাতাসে তার চুল উড়ছে। তার চুলের সাথে ওড়া ধূলোগুলোকে হঠাৎ পরাগরেণুর মত মনে হল - “বেণু মল্লিকা দোলে কুন্তলে কর্ণে।” তার আমাবস্যার মত কালো চুল। আষাঢ়ের মেঘের মত কালো চুল – “কালো কেশ মেঘের সঞ্চয়ের মত বিমুগ্ধ বেদনার শান্তি।” 

হঠাৎ অনুভব করলাম আমার মাথার ভেতরের অদ্ভুত একটা যন্ত্রণা। না, যন্ত্রণা নয়! একটা বেদনা সূচের মত ফুটছে। দু'হাতে মাথাটা চেপে ধরলাম। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। এমন একটা প্রতিক্রিয়া সে আশা করে নি, বোঝাই যায়। হাত থেকে স্যান্ডেল ফেলে চলে গেল। আমি এক দৃষ্টে তার চলে যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন যেন মনে হল, সুগার ছাড়া জয়েন্টের চেয়ে তীব্র মাদকতার মুখোমুখি আমি একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বসে পড়ে শক্ত করে আরেকটা টান দিলাম। যেন ধোঁয়ার সাথে সব অনুভূতি বেরিয়ে যায়। বেরুলো না। হঠাৎ সবকিছু প্রচণ্ড এলোমেলো মনে হল। প্রচণ্ড!

পরদিন ভোর পাঁচটায় এসে শিখা চিরন্তনের পাশের ঢিবিতে বসলাম। আজকে আমি নিখাদ ভদ্র ছেলে। ইন করা ফুল হাতা চেক শার্টটা কাল রাতে ইস্ত্রি করেছি। একেবারে ওপরের বোতামটা পর্যন্ত আটা। হাতা ভেঙ্গে রাখিনি। একেবারে পুরোটা খুলে বোতাম আটা। নীলচে জিন্সের প্যান্টটার কোথাও ছেঁড়া ফাটা নেই। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ভাল করে ধুয়ে জেল'এর নাম নিশানা মুছে দিয়েছি। সবসময় থাকা চোখের ঢুলুঢুলু ভাবটাও এখন নেই। সতর্ক অথচ খানিকটা ভাবুক দৃষ্টি। তাকিয়ে আছি নিচের রাস্তাটার দিকে। এবং ঠিক পাঁচটা থেকে পাঁচটা টানা বারো ঘণ্টা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। শুনে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু, আমি তাই করলাম। এতটা পাগলামি হঠাৎ করে মাথায় কেন চড়ে বসল ঠিক জানা নেই। অবশ্য সবকিছুরই যে কারণ থাকতে হবে, তার কোন কারণ নেই। এরও কোন কারণ নেই। কিন্তু, তার দেখা পেলাম না। সে নেই। সে নেই। সে নেই। 

পাঁচটার একটু পরেই সময় রাহাত আর মোশফেক এলো। মোশফেক পেছন থেকে হঠাৎ একটা ঝাঁকি দিল। আমি চমকে উঠলাম। তারপর পেছন ফিরে ওদের দেখলাম। পুরো রাস্তাটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। নেই। উঠে পড়লাম। রাহাত বলল, “কী রে! আজকে একেবারে ভদ্রলোক সেজে আসছিস যে?”
কোন উত্তর দিলাম না।
মোশফেক খানিকবাদে জিজ্ঞেস করল, “কখন আসছিস?”
“পাঁচটায়।”
“ও” মোশফেক ধরে নিলো বিকেল পাঁচটাতেই। ভুলটা ভাঙ্গানোর ইচ্ছে হল না। মোশফেক পেপার বিছিয়ে গাঁজা আর কাঁচি বের করল। রাহাত হিজলা পাতা আর কার্ড। মোশফেক গাঁজা কাটতে শুরু করল। আর রাহাত গাঁজার শলা বানাতে শুরু করল। চারটা জয়েন্ট বানানোর পর খানিকটা গাঁজা বাকি থাকল। 

রাহাতের কাছ থেকে নিয়ে একটা ধরালাম। হাত মুঠো করে মধম্যা আর তর্জনীর মাঝে শলাটা নিয়ে জোরে দু'টো টান দিলাম। মোশফেকের হাতে দিলাম। পরেরটার জন্য গাঁজা কাটতে কাটতে মোশফেক টান দিল। ঘুরে আবার আমার কাছে এলো। আমি এক ফুসফুস ধোঁয়া নিয়ে সামনের দিকে তাকালাম। এবং তক্ষুনি... শ্রাবণের অতলের মত, পৌষের সূক্ষ্মতার মত, বৈশাখের তীব্রতার মত তাকে দেখলাম। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “কী ব্যাপার! আজকে একেবারে ভদ্র ছেলে সেজে আছেন যে?”
মুহূর্তের মাঝে প্রতিটি শব্দ আমার কাছে অচেনা হয়ে গেল। আমি তার কথার উত্তর দেবার জন্য তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটা শব্দও পেলাম না। 
সে ই আবার বলল, “কালকে বেশি ধমকা ধমকি করে ফেলেছিলাম না'কি? বেশি ভয় পেয়েছিলেন?”
আমি মোশফেক আর রাহাতের দিকে তাকালাম। ওরা বেশ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মোশফেক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এক্সকিউজ মি!”
মেয়েটার তখনই ওদের দিকে চোখ পড়ল। বলল, “হাই! আমি নীরা।”

মোশফেক আর রাহাত নিজেদের পরিচয় দিল। 

নীরা আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কিছু বলছেন না যে?”
নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আড়ষ্ট অভিভূত হয়ে গেছি আমি।”
“জীবনবাবু আপনার খুব প্রিয় বুঝি? কালকেও তার একটা লাইন বলেছিলেন বোধহয়! পথ আলেয়ার...”
“পথ আলেয়ার খেয়ায় ধোঁয়ায় ধ্রুবতারার মতন নীরার আঁখি।”
নীরা হেসে ফেলল। অদ্ভুত মায়া জড়ানো তাতে। বলল, “আচ্ছা, আজকে আসি। ছবির হাঁটেই থাকব। আপনাদের এই ধোঁয়া টানাটানি শেষ হলে চাইলে ইমনের দোকানে একবার আসবেন।”
আমি সম্মোহিতের মত মাথা নাড়লাম। 

মোশফেক আমাকে একটা ধাক্কা মারল, “কী রে! হাতে কতক্ষণ ধরে রাখবি? এদিকে দে।”

আমি সামনে তাকালাম। নীরা চলে গেছে। যেন মুহূর্তের মধ্যেই। 

আমি উঠে গেলাম। ছবির হাঁটের দিকে হাঁটা দিলাম। পেছন থেকে মোশফেক ডাক দিল, “কী রে! কই যাস?”

উত্তর দিলাম না।

রাহাত হাঁক দিল, “পিনিক কি বেশি উঠছে নি?”

দ্রুত পা চালালাম ছবির হাঁটের দিকে। ইমনের দোকানের সামনে গিয়ে চারদিকে চোখ বুলোলাম। নীরা নেই। কোথায় গেল? বলেছিল তো থাকবে। ধুরর! মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। আবার কী ফিরে যাব? নাহ! দরকার নেই। তার চেয়ে ব্যস্ত সড়কের পাশে খানিকক্ষণ হাঁটা যায়। সেই ভাল। সোডিয়াম লাইটের আঁধারে, গাড়ির হর্ন আর রিকশার টুংটাংয়ের নৈশব্দে, আনকোরা একটা মাদকতার অনুভূতি নিয়ে অনেকটা পথ হাঁটলাম। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে একটা ল্যাম্পপোস্টের সাথে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেছি, নিজেই জানি না। 

আমার পরের দুদিন কাটল শিখা চিরন্তনের পাশের ঢিবিতে। তিন প্যাকেট বেনসন আর সতেরো কাপ চা খাওয়া হল দু'দিনে। কিন্তু, তার কোন দেখা পাওয়া গেল না। সে নেই। সে নেই। সে নেই। 

মোশফেক আর রাহাত এলো। বললাম, আমি খাব না। বেশ অবাক হল। দু'জনে শেষ করে চলে গেল। রাতটা কাটল নির্ঘুম। সম্ভবত আমার জীবনের দীর্ঘতম রাত। প্রতি মুহূর্তেই আমার মনে হল, এই বুঝি সে এলো। কিন্তু, সে নেই।

পরদিন আবার মোশফেক আর রাহাত এলো। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “কী রে! সারারাত এখানেই পড়ে ছিলি না'কি?”
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ-বোধক।

মোশফেক আর রাহাত মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কিছু বলল না। 

রাহাত বলল, “আজকে কি খাবি? না'কি আজকেও ভাব উঠছে?”

আমি দেয়াল থেকে উঠলাম। মোশফেক পেপার বিছিয়ে দিল। দু'জনে বানাতে শুরু করল। প্রথম জয়েন্ট শেষ করে দ্বিতীয়টা কেবল ধরেছি। তখনই সামনে থেকে তার কণ্ঠ এলো, “কাল সারারাত না'কি এখানেই পড়ে ছিলেন?”
আমি চমকে উঠে তার মুখের দিকে তাকালাম। অবশেষে সে এসেছে। ছোট শিশুর মত অভিমানী গলায় বললাম, “কাল আসেন নি কেন?”
“বা রে! আমার কি প্রতিদিন আসতে হবে না'কি?”

তাই তো! কী বোকার মত কথা বলে ফেলেছি। কেন আসবে সে প্রতিদিন? কে সে? কেউ না। অথচ মাত্র দু'বার দেখে তার ওপর কেমন অধিকার তৈরি করে ফেলেছি। যার এক বিন্দুও আমার নেই।

সে আবার বলল, “রাত কেমন কাটল? ঠাণ্ডা ছিল?”
“কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন। আকাশের বিস্তীর্ণ বিরামহীন ডানার ভেতর, পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল।”
“আপনি কি সব কথার উত্তরই কবিতা দিয়ে দেন না'কি? দারুণ তো!”
আমি কোন উত্তর দিলাম না। লাজুক হাসলাম। বললাম, “সেদিন চলে গিয়েছিলেন কেন?”
“হঠাৎ ইচ্ছে হল তাই। রাগ করেছেন? আচ্ছা, চলুন আজকে নিয়ে গিয়ে আপনাকে চা খাওয়াই।”
মোশফেক আর রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, “তোরা থাক। আমি আসছি।” তারপর নীরাকে বললাম, “চলুন।”

নীরা হাত ধরে আমাকে টেনে তুলল। অদ্ভুত একটা শিহরণ। মহাবিশ্বের বাইরে থেকে আসা কোন অনুভূতি। বিড়বিড় করে বললাম, “তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখায় তোমার রক্তের স্পন্দন_”

নীরা খেয়াল করল না সেদিকে। 

খানিকটা এগোতে একটা গাছে ছোট ছোট কয়েকটা ফুল চোখে পড়ল। নাম জানা নেই। নীরা বলল কয়েকটা ছিঁড়ে দিতে। এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা ছিঁড়ে আবার নীরার কাছে আসতেই দেখি ও নেই। কোথায় গেল। চারদিকে তাকালাম। কোথাও নেই। এত তাড়াতাড়ি কোথায় গেল? ডাকলাম, “নীরা...!” কোন উত্তর নেই। ফুলগুলোর দিকে তাকালাম। হাত দিয়ে পিষে ফেললাম সব। বিড়বিড় করে বললাম, “ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।” কোন গন্ধ নেই। কোন স্পর্শ নেই। কোন শব্দ নেই। সে নেই।

ঠিক পরের মুহূর্ত থেকে আমার মাথায় অদ্ভুত একটা চিন্তা কাজ করতে শুরু করল। অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর এবং অসাধারণ। অসাধারণ এবং বিপজ্জনক। বিপজ্জনক এবং সঠিক। ঠিক এটাই আমার করার আছে। ঠিক এটাই আমাকে করতে হবে। 

বাসা থেকে আমি সাধারণত গাড়ি নিয়ে বেরোই না। পরদিন বেরুলাম। শিখা চিরন্তনের ঠিক নিচে গাড়িটা পার্ক করে রাখলাম। মোশফেক আর রাহাত যথাসময়েই এলো। সময়ের হিসেবে ওদের কখনও গড়মিল হয় না। ৩৬৫ দিনে ঠিক ৩৬৫ বার ওদের সাথে আমার ঠিক একই সময়ে দেখা হয়। একবারও বেশি কিংবা কম, একটুও আগে কিংবা পরে নয়।

তখনও আমি ঠিক করতে পারছিলাম না কাজটা আমি সত্যিই করব কি'না। মাত্র তিনবারের দেখায় এই মোহ আমার চিরদিন থাকবে কি'না! অথচ তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম, এই মেয়েটাকেই আমার চিরদিন চাই। হোক সেটা আলোতে বা আঁধারে। স্নায়ুগুলো প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে আছে। Low Volume এ Poets of the Fall এর Sleep ছেড়ে কানে হেডফোন দিলাম। দু'টো জয়েন্ট শেষ করলাম। তৃতীয়টার অর্ধেক শেষ হতেই নীরার দেখা এলো।

কোন ভূমিকা ছাড়াই বলল, “চলুন আজকে চা খাওয়া যাক।”

বলে আমার দিকে হাত বাড়ি দিল। আমি ডান হাতে তার হাত ধরে উঠেই বা'হাত তার কাঁধে রাখার ভঙ্গিতে তার হাতে ১০ মিলিগ্রাম … … … … … পুশ করে দিলাম। প্রায় সাথে সাথেই সে আমার বুকে ঢলে পড়ল। আশেপাশে যারা আছে, প্রায় সবাই হয় গাঁজার নেশায় আচ্ছন্ন, নয়তো প্রেমিকার ঠোঁটে আর বুকে মগ্ন। এদিকে ভাল ভাবে খেয়াল করার সময় কারোরই নেই। নীরার এক হাত আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে আমার এক হাতে তার কোমর ধরে তাকে প্রায় সোজা রেখে নিয়ে গাড়িতে তুললাম। মোটামুটি উল্কার বেগে গাড়ি ছোটালাম। কোন সিগনাল মানলাম না। স্পিডোমিটারের কাঁটা চড়তে থাকল সত্তর … আশি … নব্বই …। গন্তব্য গাজীপুর শালবনের মধ্যে আমাদের বাংলো বাড়ি। আমাদের খোঁজ কেউ জানবে না। শুধু আমি আর নীরা। আর কেউ না। আর কিছু না। কেউ নেই।

ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে শালবন অবধি পৌঁছে গেলাম। এখানে গতি কমিয়ে দেয়া দরকার। উল্টো বাড়িয়ে দিলাম। শালবনের এবড়ো থেবড়ো, আঁকাবাঁকা রাস্তার মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগোতে শুরু করল। হঠাৎ একটা বাক নিতেই এক জোড়া ছেলে মেয়ে চোখে পড়ল। একটা শাল গাছের সাথে হেলান দিয়ে ছেলেটা মেয়েটাকে রীতিমতো পিষে রেখেছিল। হঠাৎ গাড়ির শব্দ আর হেডলাইটের তীব্র আলোয় দু'জনেরই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় মেয়েটা কী ভেবে শালবনের ভেতরে ঢুকে না গিয়ে উল্টো রাস্তার দিকে দৌড় দিল। ব্রেক কষার সময় ছিল না। তারপরও ব্রেক কষে গাড়ি পাশ কাটাতে গেলাম। কিন্তু, অন্য পাশেও শালবন। গাড়িটা সজোরে একটা গাছের সাথে ধাক্কা খাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই। ধবধবে আঁধার!

যখন চোখ খুললাম, আমার চোখের সামনে মোশফেক বসে আছে। কিন্তু, নীরা কোথায়? আতঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “নীরা কোথায়?”

মোশফেক নিঃস্পৃহ গলায় বলল, “আজ ১৭ই ফেব্রুয়ারি।”
“তা দিয়ে আমি কী করব? নীরা কোথায়?” আমি রীতিমত চিৎকার করে উঠলাম।
“পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মত সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; আবার তাহারে কেন ডেকে আন? কে হায় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?”

আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠলাম। মাথার ভেতর হঠাৎ যেন কালবৈশাখী শুরু হয়ে গেল। ১৭ ফেব্রুয়ারি … নীরা … শালবন … কবিতা … নীরা … ১৭ই ফেব্রুয়ারি …। আমি যন্ত্রণায় যেন মরে গেলাম। মাথার ভেতর মনে হচ্ছে প্রতিটা শিরা উপশিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে। দু'হাতে মাথা চেপে ধরলাম। 

মোশফেক বলল, “থাক! আর কষ্ট করতে হবে না। আজ ১৭ই ফেব্রুয়ারি। তিন বছর আগে এই দিনে নীরা মারা গিয়েছিল।”
আমি চমকে মোশফেকের দিকে তাকালাম। মোশফেক বলতে থাকল, “আজকের দিনের আরেকটা বিশেষত্ব আছে। আজকে জীবনানন্দের জন্মদিন। দু'টো মিলে যাওয়ায় নীরা মারা যাবার পর থেকে তোর মাঝে দু'টো পরিবর্তন হল। এক, তুই জীবনানন্দের কবিতা প্রচুর পড়তে শুরু করলি। দুই, গাঁজা খেতে শুরু করলি। দ্বিতীয়টার সূত্রে আমার আর রাহাতের সাথে পরিচয় হল। তোর ফ্যামিলির কাছে সব শুনলাম। এবং পরের বছর ১৭ই ফেব্রুয়ারির কয়েক দিন আগে নিজের চোখেই দেখলাম। যেন অদৃশ্য কারও সাথে তুই কথা বলছিস। এবং ১৭ই ফেব্রুয়ারি তাকে নিয়ে পালানোরও চেষ্টা করছিস। কিন্তু, ঠিক এই জায়গাটায় এসে গাড়ি ব্রেক করছিস।”
আমি চিৎকার করে উঠলাম, “মিথ্যে! সব মিথ্যে! আমি নিজে নীরাকে নিয়ে এসেছি।”

মোশফেক আমার পকেটে হাত দিয়ে ইনজেকশনটা বের করল। তাকিয়ে দেখি ওটার পুরোটা মেডিসিন এখনও রয়ে গেছে। মোশফেক আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। সামনে আমার গাড়িটা পার্ক করা। পুরোপুরি অক্ষত। 

বলল, “আর কিছু বলবি?”
আমি মাথা নাড়লাম। না-বোধক।

তীব্র একটা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল। আকাশ থেকে জ্যোৎস্না যেন উপচে পড়ছে। অদ্ভুত একটা মাদকতা! শুধু সে নেই। সে নেই। সে'ই নেই!

হঠাৎ মোশফেক বলল, “নীরার সাথে দেখা করবি?”
আমি চমকে মোশফেকের দিকে তাকালাম। কী খেলা শুরু করেছে ও? বললাম, “মানে কী এসবের?”
মোশফেক কিছু বলল না। শুধু একটা জয়েন্ট ধরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল, “তিন টানে শেষ করবি।”

সেটা নিয়ে আমি পুরোটা ফুসফুস ভরিয়ে দিলাম ধোঁয়ায়। শেষ করে আরেকবার তাকালার জ্যোৎস্নার দিকে। চোখ পড়ল চাঁদে। হঠাৎ দেখলাম, নীরা! জ্যোৎস্নার সাথে নেমে আসছে। একটা তরল অবয়ব। জ্যোৎস্নার সাথে ছড়িয়ে পড়ছে আমার চারদিকে। নীরা! নিজের অজান্তেই উচ্চারণ করলাম, “কল্পনার হাঁস সব- পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর; উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।”




Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক