বিশ্বাসঘাতক
আজকে সন্ধ্যে থেকে মতির হৃদপিণ্ডটা অস্থির হয়ে আছে। আজকে জীবনের প্রথম অপারেশন। জীবনের প্রথম অপারেশনে এত বড় দায়িত্ব কেউ পায় না। মতির পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল আরও কম। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স। তার পরেও মতি এই দায়িত্ব পেয়েছে। কারণ, দলে উপযুক্ত আর কেউ নেই। ও ছাড়া দলের সবাই থাকত ঢাকায়। এমনকি ক্যাপ্টেনও। অনেকে তো সাতার পর্যন্ত জানে না।
অগত্যা, গতকাল সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন ওকে একটা বাঁশের কঞ্চি ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা নিয়ে নদীটা পাড়ি দিবি। নদীর পানিও যেন টের না পায়।’ মতি নিঃশব্দে নেমে গেল। হাঁটু পরিমাণ পানিতে গিয়েই ডুব দিল। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে নিঃশ্বাস না নিলে কারও বোঝার সাধ্য ছিল না, ওখান দিয়ে কেউ যাচ্ছে।
ফিরেও এলো একইভাবে। ক্যাপ্টেনের মুখে হাসির আভা ফুটে উঠল। কিন্তু, মুখে কিছু বললেন না। দু’দিন পরেই হয়তো কোন অপারেশনে যে ছেলে মারা যাবে, তার প্রশংসা করে কি লাভ? মারা যাবে হয় তো কালকেই। নিশ্চিত মৃত্যুকে যে আলিঙ্গন করতে জানে, তাকে উজ্জীবিত করতে প্রশংসাবাক্যের প্রয়োজন হয় না।
নদীর পাড়ে কাশবনের মধ্যে বসে মতি এখন কাশের ডগা চিবোচ্ছে। খানিক পরে ক্যাপ্টেন এসে মতির পাশে বসল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ক্যাপ্টেনই বললেন, ‘কি রে! ভয় করছে?’
মতি প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।
বাড়িতে কে কে ছিল?
বাপ, মা, বইন।
মনে কর তাদের কথা।
মতি চোখ বন্ধ করল। দেখল চোখের সামনে আগুন জ্বলছে। তাদের কুড়ে ঘরটা দাউ দাউ করে পুড়ে যাচ্ছে। তার মা বের হতে না পেরে অসহায়ের মত জ্বলে মরছে। তার বাবাকে পরম উল্লাসে একজন বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করছে। তার মুখের ওপর আবার একটা লাথি দিয়ে কেউ তার দিকে রাইফেল তাক করল। পাশ থেকে কেউ বলল, ‘ছোড় দো। বাচ্চা হ্যাঁয়।’ কেউ তার এগার বছরের বোনটাকে হিংস্র শকুনের মত টেনে জীপে তুলছে। সে অথর্বের মত মাটিতে পড়ে আছে। নিজের হাতটাকেও উঁচু করে ধরার মত শক্তি তখন তার অবশিষ্ট নেই।
মতি আর সহ্য করতে পারল না। চোখ খুলে ফেলল। বড় বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলো।
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘এখন ভয় করছে?’
মতি নাসূচক মাথা নাড়ল।
ঠিক আছে। পুরোটা মনে আছে তো?
মতি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল।
আবার শোন। ওদের লঞ্চ মাঝামাঝি আসলেই আমরা কাশবনের ভেতর থেকে অ্যাটাক করব। তখন ওরাও লঞ্চ থামিয়ে পাল্টা অ্যাটাক করবে। তখন তুই গিয়ে লঞ্চের নিচে ফুটো করে দিয়ে আসবি। লঞ্চ না থামালে চলন্ত লঞ্চেই ফুটো করবি। পারবি না?
মতি আবারও হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, তার হৃদপিণ্ডটা আশ্চর্য রকমের স্থির। সেখানে শুধু একটাই অনুভূতি- প্রতিহিংসা।
মাথা কচুরিপানা বেধে মতি গলা পানিয়ে দাড়িয়ে আছে। কাঁধে একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। লঞ্চটা এদিকে এগিয়ে আসছে। মতি অপেক্ষা করছে প্রথম গুলির শব্দের জন্য। শব্দটা শোনার সাথে সাথেই পানিতে ডুব দিল। দু’পাশ থেকেই প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। ওর দলের লোকেরা পানির খানিকটা ওপর দিয়েই গুলি করছে, যেন মতির গায়ে গুলি না লাগে। কিন্তু, পাকিস্তানীরা সেটা করছে না। ওরা গুলি করছে এলোপাথাড়ি।
এর মধ্যেও মতি আশ্চর্য রকমের শান্ত। নদীর ওপাশেই পাকিস্তানীদের ক্যাম্প। সেখান থেকে সাহায্য আসার আগেই লঞ্চটাকে ডুবিয়ে দিতে হবে। ভাগ্য ভাল। ওরা লঞ্চটাকে থামিয়ে দিয়ে শুধু কোন রকমে মুক্তিযোদ্ধাদের থামিয়ে রেখেছে। বোধ হয় সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছে।
যতটা সম্ভব, তার চেয়েও নিঃশব্দে লঞ্চের নিচে গিয়ে পৌঁছল। খুব বেশি সময় নিলো না লঞ্চের নিচে ফুটো করতে। লঞ্চের ভেতর কোলাহল আগেই ছিল। এখন সেটা রূপ নিলো আতঙ্ক আর চিৎকারে। পরম তৃপ্তি নিয়ে মতি উল্টো দিকে ঘুরল।
হঠাৎ, মনে হল তপ্ত লোহার মত কি যেন তার ঘাড়ের মাংসপেশি ভেদ করে বেরিয়ে গেল। মতি শুধু একবার চোখ মেলে দেখল সেদিকে। তারপর নীরবে চোখ বন্ধ করল।
যখন মতির জ্ঞান ফিরল, তখন সে নদীর অন্য পাড়ে। রক্ত আর কাঁদায় মাখামাখি। ডান হাতটা উঁচু করতে গিয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দেহ অবশ হয়ে এলো। চিৎকার করার শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। কাঁধের দিকে একবার তাকাল। কাঁদা জমে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। অতিকষ্টের চারিদিকে একবার তাকাল। কেউ নেই। কেউ নেই। কাউকে বোধ হয় দেখা গেল। হ্যাঁ, এদিকেই আসছে। ঝাপসা চোখে মতি তাকায় সেদিকে। বাঙালি? হ্যাঁ, বাঙালিই তো। মতি নিশ্চিন্তে দু’চোখ বন্ধ করে। এবার আর কোন দুশ্চিন্তা নেই।
আবার জ্ঞান ফেরার পর মতি পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝতে পারল না। তার গুলি লেগেছে ডান কাঁধে। কিন্তু, সে বা’কাঁধটাও নাড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু, এত শক্তি সে পেল কোথায়?
চোখ দুটো খুলে সে যা দেখতে পেল, তাতে সে একটা প্রচণ্ড চিৎকার দিতে চাইল। কিন্তু, ঠোট দিয়ে একটা শব্দও বের হল না। মুখে কেউ রুমাল গুজে দিয়েছে। সে এখন মিলিটারি ক্যাম্পে একটা গাছের সাথে বাধা। কিভাবে কি হল কিছুই সে বুঝতে পারছে না।
খানিকপরে দেখল সেই বাঙালিটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। মতি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মতি কিছু বলার আগেই, লোকটা তার পেটে একটা লাথি মারল। মতির নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।
লোকটা তার কানের কাছে এসে বলল, ‘তোরে ধরায় দিয়া আমার পরমোশন হইছে। আমি এখন এই গেরামের রাজাকার বাহিনীর পরধান। তোর লাথ্থি মাইরা সেইটা উজ্জাপন করলাম।’
মতি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার বিশ্বাস হতে চায় না, মাতৃভূমির সাথে কেউ এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে!
মতি অস্ফুট স্বরে ঠোট নাড়ে। রাজাকারটা বলে, ‘কি কস? জোরে ক?’
মতি আবার ঠোট নাড়ে অস্ফুট স্বরে শোনা যায়, এক লঞ্চ মিলিটারি আমার কিচ্ছু করতে পারে নাই। তুই একলা বিশ্বাসঘাতক আমারে...’ রাজাকারটার এতে বিন্দুমাত্র বিকার হল বলে মনে হল না। বরং আগ্রহ ভরে সে মতির মুখের কাছে কান নিয়ে তার কথা শুনতে লাগল। অস্ফুট স্বরে শুনতে পেল, ‘অন্যের মায়ের দিকে হাত বাড়াইলে, সেই পাপ মাফ করা যায়। কিন্তু, যারা নিজের মায়রে অন্যের হাতে তুইলা দেয়, সেই পাপ স্বয়ং খোদাও মাফ করতে পারে না।’
Comments
Post a Comment