এই শহরের আকাশটাতে মেঘ জমেছে
-আসছে?
-না এখনও আসে নাই।
-আর কতক্ষণ?
-আমি কী জানি কখন আসবে? আমি তো চারটা থেকেই দাড়ায় আছি সৌরভের জন্য।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা সব আছি ৪ নাম্বার রোডে। একুশে একাডেমীর গলিতে।
-ঠিক আছে। তোরা আড্ডা দে। ওরে নিয়ে সন্ধ্যার দিকেই আসব। আলো থাকলে ঝামেলা।
ফোনটা কেটে দিলাম। রাকিন নিশ্চিত চেতছে। করার কিছু নেই। সৌরভ দেরি করছে, সেটা আমার দোষ না।
সময় কাটানোর জন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করা যায়। কী নিয়ে? কী নিয়ে? আচ্ছা, সিগারেট চায়ের সাথে খেলে নিকোটিন বেশিরভাগ অংশ চলে যাবে, পাকস্থলীতে। কিন্তু, তাতে পিনিক বাড়ে কেন?
কেন বাড়ে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় পেলাম না। সৌরভ এসে গেছে। আমার সামনে এসে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করলাম, “সৌরভ?”
-হ্যাঁ, তুমি নিশ্চয়ই রবিন?
হাসিমুখে মাথা নাড়লাম- হ্যাঁ, আমিই।
-তোমার প্রোফাইল পিকচারের সাথে চেহারার একেবারেই কোন মিল নেই।
-সবাই ই বলে।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম, “বেনসন?”
-মার্লবরো।
দোকানের পিচ্চিটাকে ডেকে বললাম, “দু'কাপ চা, একটা বেনসন আর একটা মার্লবরো।”
খানিকক্ষণ, কেউ কোন কথা বললাম না। সৌরভকে ভাল করে একবার দেখে নিলাম। ফর্সা গায়ের রং রোদে পুড়ে যেমন খানিকটা তামাটে হয়ে যায় তেমন গায়ের রং, বেশ লম্বা - পাঁচ ফুট দশ হবে, খুব বেশি মোটা বা চিকন কোনটাই নয় আর চেহারায় কেমন একটা মায়া মায়া ভাব; সব মিলিয়ে সুদর্শন বলা যায়। রিয়া ওর প্রেমে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না।
চা আর সিগারেট দিয়ে গেল। লাইটার বের করে সিগারেট ধরিয়ে ওর দিকে লাইটার এগিয়ে দিলাম। মার্লবরো ধরাল। বললাম, “তাহলে শুরু কর”।
“হ্যাঁ, করছি।” বলে খানিকক্ষণ চুপ থাকল। তারপর আবার শুরু করল-
-রিয়া আর আমি একই মহল্লায় থাকতাম। একই মহল্লায় বলতে, ওদের ফ্লাটের উল্টো দিকের ফ্লাটেই। দু'জনের বাসাই তিন তলায়। দু'জনের বারান্দাটা একেবারে মুখোমুখি।
-বোধ হয় স্রষ্টা আগে থেকেই সব প্লান প্রোগ্রাম করে রেখেছিলেন।
-হয় তো। যাই হোক, রিয়া জন্মের পর থেকেই ওখানে। আমরা আসি আব্বুর ট্রান্সফারের সুবাদে। আমার আব্বু ইন্সপেক্টর অব পুলিশ। এখন হাজারীবাগ থানায় আছে। যাই হোক, প্রথম দিন এসেই বাসা গুছিয়ে মোটামুটি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। বারান্দায় এসে বসে গান শুনছিলাম। Nightwish এর While Your Lips are Still Red.
-এখনও মনে আছে, সেদিন কী গান শুনছিলে? বাব্বাহ!
-হ্যাঁ, কারণ, সেদিন আমি রিয়াকে প্রথমবার দেখেছিলাম। পরে যতবার ওকে দেখতে বারান্দায় বসে থেকেছি, এই গানটাই শুনেছি। যাই হোক, প্রথম দেখায় প্রেম বলে কিছু আছে কি'না সেটা আমার ঠিক জানা নেই। কিন্তু, আমার ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছিল। আমি রিয়াকে দেখেছিলাম এবং ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এতটা মুগ্ধতা কখনও কোন মানুষ কোন মানুষের প্রতি হয়েছে কি'না আমার ঠিক জানা নেই। ওই যে তুমি বললে না, স্রষ্টা আগে থেকে সব ঠিক করে রেখেছে। আমারও ঠিক তাই মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমার জন্ম এই পৃথিবীতে আর কিছুর জন্যে নয় শুধু রিয়াকে ভালবাসার জন্য হয়েছে। এই পৃথিবীতে আমার বেঁচে থাকার একটাই অর্থ, আমি রিয়াকে ভালবাসব। পৃথিবীতে আমার আর কিছুর দরকার নেই, যদি আমি শুধু রিয়ার ভালবাসা পাই।
রিয়াও বুঝেছিল সব। বুঝবে নাই বা কেন? একটা ছেলে কেন সব কাজ বাদ দিয়ে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা যদি বারান্দায় পড়ে থাকে,আর মেয়েটা বারান্দায় এলেই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে, সেটা না বোঝার কিছু না। রিয়াও বুঝেছিল। তাই, কোন এক সুবর্ণ সকালে ওই আমাকে ডেকে বলল, “অ্যাই যে সাহেব, শুধু কি ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকবেন? না'কি কিছু বলবেনও?”
আমি কিছু বলতে পারি নি। শুধু একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। কোন মানবী এতটা সুন্দর কীভাবে হয়! আমি বুঝতে পারি নি। আজও পারি না।
রিয়াই আবার আমার মুখের সামনে দু'বার তালি দিয়ে বলল, “স্ট্যাচু হয়ে গেছ না'কি?” বলেই অনবরত হাসতে লাগল। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই হাসি দেখতে লাগলাম। কারও হাসি এত সুন্দর কীভাবে হয়?
রিয়াই আবার বলল, “কিছু কি বলবে?”
এবার আমার সবটুকু জড়তা ভেঙ্গে বললাম, “বলার কি আদৌ কোন দরকার আছে? তুমি কি জানো না আমি কী বলব?”
-বাব্বাহ! একেবারে কবি হয়ে গেছ দেখছি। প্রেমে পড়লে দেখি সত্যি সত্যিই সবাই কবি হয়ে যায়।
আমি আর কিছু দেখতে পারি নি। আমি শুধু তখন রিয়াকে দেখেছি। আমার আর পুরো পৃথিবী অন্ধকার। আমি আর কিছু শুনতে পারি নি। আমি শুধু শুনেছি রিয়ার হাসির আওয়াজ। আমার বাকি পুরো পৃথিবী নিঃশব্দ। আমি আর কিছু অনুভব করতে পারি নি। আমি শুধু অনুভব করেছি আমার ভালবাসা। আমার বাকি পুরো পৃথিবী তখন অনুভূতিহীন। তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না, কতটা তীব্র সে অনুভূতি।
“তোমার কথার ধরণ দেখে তো মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই তুমি কবি হয়ে গেছ। একটু বেশিই রোমান্টিক কবি। তা তোমাদের ব্রেক আপ হল কীভাবে?”
হঠাৎ আমার প্রশ্নে সৌরভ খানিকটা হতচকিত হয়ে গেল। বোধ হয় একটু বেশিই নস্টালজিক হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল-
-আসলে সমস্যাটার শুরু আমাদের ধর্ম নিয়ে।
খানিকটা অবাক হলাম। বললাম, “ধর্ম নিয়ে এই টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে যদি দু'জনের মধ্যে ঝগড়া লাগে, তোমার কি মনে হয় না, সেটা একটা হাস্যকর বিষয়? সহনশীলতা তো দু'জনের থেকেই আশা করা যায়।”
সৌরভ শুরু করার আগেই আমি পিচ্চিটাকে ডেকে আরও একটা বেনসন আর একটা মার্লবরো দিতে বললাম। তারপর সৌরভকে বললাম, “হ্যাঁ, শুরু কর।”
-আসলে রিয়া হিন্দু ছিল, এটা নিয়েও আমার কোন সমস্যা ছিল না। কিংবা, আমি মুসলিম ছিলাম এটা নিয়েও রিয়ার কোন সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল অন্য খানে। ওই যে তুমি টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরির কথা বললে না? সহনশীলতার কথা বললে না? তোমার কি মনে হয়, এই টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে এসেও আমাদের সমাজ আমাদের সম্পর্কটাকে মেনে নেবে? আমাদের সমাজের মানুষদের মাঝে ততটুকু সহনশীলতা আছে?
-Society the fucking bullshit. সমাজ আমার জন্য কী করেছে যে আমি সমাজের জন্য ভাবতে যাব?
সৌরভ হেসে ফেলল। নিষ্প্রাণ হাসি। কিংবা আমার অদূরদর্শিতাকে তাচ্ছিল্য করার হাসি।
-সমাজকে যতটাই অগ্রাহ্য করার চেষ্টা কর না কেন, তোমাকে এই সমাজেই বেঁচে থাকতে হবে। তুমি তা করতে বাধ্য। তোমার হাতে অন্য কোন উপায় নেই। সমাজ কখনও আমাদের সম্পর্ককে মেনে নিত না। তাই আমরাও আমাদের এই সম্পর্কের কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পাই নি। রিয়া এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারত না। কিন্তু, যখন দেখত এ ছাড়া কোন উপায় নেই তখন ওর ইচ্ছে হত, সবকিছু ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিক। ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তাই আমাদের মাঝে বারেবারে অকারণে কিংবা অনেক ছোট ছোট কারণে বারবার ঝগড়া হত।
আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার আরেকটা কারণ হতে পারে আমি ওকে প্রচণ্ড ভালবাসতাম। অবাক হতে পার। তবে এটাই সত্যি। ওকে প্রচণ্ড ভালবাসতাম বলেই, আর কোন ছেলের সাথে ওর মেলামেশা আমি সহ্য করতে পারতাম না। সহ্য করবই বা কেন? ওকে ভালবাসার পরে আমিও তো কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাই নি। তাহলে ও কেন অন্য কোন ছেলের সাথে মিশবে।
ওকে অন্য কোন ছেলের সাথে দেখলে আমার বুকের মধ্য যে কতটা যন্ত্রণা হত, তা তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না। আমি রীতিমত পাগলের মত হয়ে যেতাম। একবার তো রেগে গিয়ে ওকে চড় পর্যন্ত মেরেছিলাম।
সৌরভ থামল কিছুক্ষণের জন্য। বড় বড় করে দু'টো নিঃশ্বাস নিলো। তারপর আবার বলল, “ফলাফল যা হবার তাই হল। আমাদের দু'জনের মধ্যে কেউই সহনশীলতা দেখাতে পারি নি। না আমি না রিয়া। তাই সম্পর্কটাই ভেঙ্গে গেল।”
-তাহলে এখন আবার রিয়াকে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছ কেন?
-ওই যে বললাম, ভালবেসেছি। আমাদের মধ্যে যাই হোক, ওকে আমি ভালবাসি আজও। ওর মাঝে আমি আজও ততটা মুগ্ধ,যতটা হয়েছিলাম ওকে প্রথমবার দেখার পর। সেটা রিয়াও বাসে। হ্যাঁ, এটা সত্যি তিন মাস ধরে আমাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। আমরা দু'জন দু'জনকে একেবারে দেখতে পারি না। কিন্তু, তবুও আমরা দু'জন দু'জনকে ভালবাসি। কিন্তু, এই ভালবাসার চেয়ে বেশি এখন রাগ আর অভিমান। অন্যকে যন্ত্রণা দিতে আমরা দু'জন এখন উঠে পড়ে লেগেছি। এই যে রিয়ার সাথে তোমার বন্ধুত্ব, সেটা কেন করেছে জানো? আমাকে যন্ত্রণা দিতে। কারণ, ওর সাথে আমি কোন ছেলেকে সহ্য করতে পারি না।
-এসব তোমার উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা। আমি আর রিয়া যথেষ্ট ভাল বন্ধু।
সৌরভ কোন উত্তর দিল না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে মার্লবরোটা শেষ করল। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তুমি কি রিয়াকে ভালবাস? কিংবা রিয়া তোমাকে?”
-রিয়ার কথা জানি না। হয়তো ও আমাকে স্রেফ একটা ভাল বন্ধু হিসেবেই দেখে। হয়তো বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু। কিন্তু, আমি রিয়াকে ভালবেসেছি, ভালবাসি, ভালবাসব। এবং আমাদের দু'জনের মধ্যে যদি তৃতীয় কেউ চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করে, তার চোখ দু'টো উপড়ে ফেলতেও আমি দ্বিধা-বোধ করব না।
সৌরভ খানিকক্ষণ তীব্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
বললাম, “সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চল এবার ওঠা যাক।”
-তুমি বলেছিলে আজ আমরা এখান থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে যাব।
-সিদ্ধান্ত যেতে যেতে নেয়া হয়ে যাবে।
-এতটা নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছ? সমস্যাটা এত সাধারণ কিছু নয়।
-আমিও সাধারণ কেউ নই। আমি যখন বলেছি, ফলাফল চলে আসবে, তো আসবে।
একটু থেমে বললাম, “দাড়াও বিলটা দিয়ে আসি।”
সৌরভ আমাকে থামিয়ে বলল, “আমি দিয়ে আসছি।”
আমি রাকিনকে কল করলাম, “হ্যাঁ, আমরা আসছি। তোরা ওইখানেই আছিস?”
-হ্যাঁ, রোডে ঢুকেই প্রথম গলিটায়। একবার শুধু ওরে আন। বাকিটা আমরা দেখতেছি।
-আচ্ছা। আসতেছি শুওরের বাচ্চাটাকে নিয়ে।
-ও একেবারে মেরে ফেলব?
-হ্যাঁ।... না না না। একেবারে মারিস না। তবে বাঁচাতে যেন ডাক্তারদেরই হাড্ডি মাংস এক হয়ে যায়।
-কাটাকাটি?
-ওইটা কম করিস। না করলেই ভাল।
-আচ্ছা। তুই মারবি?
-নাহ! জানোসই তো, বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে আমার হাত কাঁপতে থাকে। এখন দেখা গেল ওরে একখান থাপ্পড় মেরে শুরু করতে যাব, তার আগে আমার হাত কাঁপা শুরু করল। কী বিশ্রী ব্যাপার!
ওপাশে রাকিনের হো হো করে হাসির আওয়াজ শোনা গেল।
কল কেটে দিলাম।
আকাশে মেঘ করতে শুরু করেছে। এটা বৃষ্টির মেঘ না। ঝড়ের মেঘ। একটু পরই বাতাসের নৃত্য শুরু হবে।
যেতে যেতে সৌরভকে বললাম, “একটু পরই বৃষ্টি শুরু হবে। এদিক দিয়ে এসো। শর্টকাট।”
সৌরভ কথা বাড়াল না। আমার পিছু পিছু আসতে শুরু করল। খানিক বাদে বলল, “আমরা কিন্তু এখনও কোন সিদ্ধান্তে আসি নি।”
কিছু বললাম না। শুধু ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি জমা করলাম।
-কিছু বলছ না যে?
-তোমাকে বলেছিলাম না, আমাদের দু'জনের মধ্যে যদি তৃতীয় কেউ চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করে, তার চোখ দু'টো উপড়ে ফেলতেও আমি দ্বিধা-বোধ করব না। ওটাই সিদ্ধান্ত।
সৌরভ কিছু বলল না। শুধু তীব্র চোখে তাকিয়ে রইল। আমার দিকে না। রাকিনের দিকে। তারপর সেটা ঘুরে গেল ফয়সালের দিকে। তারপর সোহান আর অমিতের দিকে। তারপর আবার আমার দিকে এসে চোখ দু'টো স্থির হল। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলাম। পা'দুটো কাঁপছে। হাত দু'টোও। দু'হাত দু'দিকে ছড়িয়ে দিলাম পাখির মত। চিৎকার করে বললাম, “রিয়া... তুমি কি জানো...? আমি তোমাকে এক আকাশ বৃষ্টির সমান ভালবাসি...।”
সেই বৃষ্টি তখন রাস্তা থেকে সৌরভের রক্ত ধুয়ে ফেলতে ব্যস্ত।
রিয়ার বাসার সামনে পৌঁছলাম কাকভেজা হয়ে। সামনের রাস্তাটাতেই দাড়িয়ে রিয়াকে কল করলাম, “দুস্ত, একটু নিচে আয়।”
রিয়া নেমে এলো। বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজেছে। চুলগুলো এখনও ভেজা। ট্রয়ের ক্রাইসিসও এতটা সুন্দর ছিল কি'না কে জানে?হঠাৎ করেই ক্রাইসিস আর রিয়ার মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল পেলাম। আগামেমনন আর একিলিসের মধ্যে বিবাদের কারণ ছিল ক্রাইসিস। আচ্ছা আমার আর সৌরভের মধ্যে একিলিস কে?
রিয়াই চিন্তায় ছেদ ঘটাল, “কী রে! ডাকছিস কেন?”
-দুস্ত, সৌরভ কি তোকে বেশি জ্বালায়?
-ওই হারামজাদার নাম নিতেছিস কি করতে? ওর জ্বালায় আমি পাগল হয়ে গেলাম। তোরে না বলছিলাম, ওর একটা ব্যবস্থা কর।
-ব্যবস্থা করেই এসছি।
-কী করছিস! রিয়ার মুখে খানিকটা আতঙ্ক ফুটে উঠল।
-আপাতত DMC তে ভর্তি আছে। বাঁচার চান্স কম।
রিয়া কিছু বলল না। খানিকক্ষণ স্থবির হয়ে দাড়িয়ে রইল। ঝড় শুরুর আগের গম্ভীর আকাশের মত। তারপর হঠাৎ করেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, “তুই এটা কি করছিস! তুই এটা কি করছিস! প্লিজ, তোর পায়ে পড়ি আমাকে সৌরভের কাছে নিয়ে চল। রবিন, তোর পায়ে পড়ি। ওকে ছাড়া আমি মরে যাব।”
ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি জমা করলাম। বিষণ্ণ হাসি।
রিয়া সৌরভের বেডে বসে আছে। আমি পাশে একটা টুলে।
সৌরভকে বললাম, “বলেছিলাম না, আমি যখন বলেছি তখন একটা সিদ্ধান্ত হবেই।”
সৌরভ কিছু বলল না। আমি রিয়ার হাতটা ধরে সৌরভের হাতে রাখলাম।
রিয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, “রবিন!”
খানিকক্ষণ কিছু বলতে পারলাম না। গলাটা ধরে এলো। নিজেকে খানিকটা শান্ত করে বললাম, “তোকে ভালবাসি তাই...”খানিকক্ষণ চুপ থেকে সৌরভের দিকে তাকিয়ে আবার বললাম, “আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম রিয়া কাকে নিয়ে সুখী হবে। আমি জেনে গেছি।”
ওদের দু'জনের কেউ কিছু বলল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। আমিই আবার বললাম, “রিয়া দেখেছিস, আমার হাত দু'টো কাঁপছে। রক্তে হরমোন দৌড়াতে শুরু করেছে। এটা কীসের উত্তেজনা জানিস? আনন্দের। নিজের ভালবাসাকে হাসিমুখে দেখার আনন্দে। এ কি! মুখ এমন পেঁচার মত করে রাখছিস ক্যান? হাস। হাস বলছি। নইলে থাবড়া দিয়া দাঁত ফালায় দিব।”
রিয়া হাসল। বিষণ্ণ হাসি। তবু আমি জানি, এই হাসির মাঝে প্রশান্তি আছে। ভালবাসা আছে।
বেরিয়ে এলাম। আমার কষ্টে আকাশটা কাঁদতে শুরু করেছে। অঝোর জল নেমে আসছে এই শহরে। ধূসর মেঘে ছেয়ে গেছে। আমি ফিসফিস করে বৃষ্টিকে শোনাচ্ছি:
এই শহরের আকাশটাতে মেঘ জমেছে
পাথর পাথর মানুষগুলোর মন গলেছে
শব্দ ঠোঁটে পথ ভুলেছে, সুর তুলেছে
অবাক চোখে জল নেমেছে, জল নেমেছে...
আজ আমার সাথে বৃষ্টিও কাঁদছে। আজ বৃষ্টির সাথে আমি কাঁদছি। আমার ভালবাসাকে হাসিমুখে দেখার কান্না। বৃষ্টি আজ আমার সাথে হাসবে? অবাক চোখের হাসি! আজ তুমি আমার সাথে কাঁদবে। এই শহরের আকাশে ধূসর চোখে জল নামাবে? আজ অবাক চোখে জল নামাবে? আজ যে এই ধূসর শহরটার আকাশে মেঘ জমেছে।
Comments
Post a Comment