ষোল আনা, বাঙালিয়ানা

“এক ঘণ্টার মধ্যে বেশিরভাগ জাপানী সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তারা হয় নিজেদের গুলিতে আত্মহত্যা করে অথবা আমাদের গুলিতে মারা যায়। তারা কখনও আত্মসমর্পণ করে নি। দলের কমান্ডার তখনও জীবিত। তিনি ছিলেন গর্বিত ও দুঃসাহসী। তিনি অবজ্ঞার সাথে তার তলোয়ার উঁচু করে ধরলেন এবং আমাকে আহ্বান করলেন তার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে।”
-লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী (দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান: পৃষ্ঠা ২৬)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পরও জাপান এত কম সময় এত দ্রুত কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল এবং বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি(বর্তমানে তৃতীয়) হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল তার এর চেয়ে বড় উত্তর বোধ হয় হতে পারে না। তাদের উন্নতির এক এবং একমাত্র কারণ হচ্ছে, নিজেদের জাতীয়তার প্রতি তাদের প্রবল অহংকার। প্রবল জাত্যভিমান তাদের রক্তে মিশে আছে।

এই প্রবল জাত্যভিমানের ভেলায় চড়েই বারবার শোষিত হয়েও পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির কাতারে উঠে এসেছে চীন। জাপানের মতই তারা নিজেদের পণ্য ভিন্ন কিছু ব্যবহার করে না। নিজেদের ভাবে পৃথিবীতে অদ্বিতীয় এবং সেই বিশ্বাসকে তারা সত্যি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক পরাজিত শক্তি জার্মানির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। হিটলার যতই নৃশংস হোক না কেন, এ কথা যে কেউ স্বীকার করবে তার দেশপ্রেমে কোন খাদ ছিল না। আর তাই বিশ্বযুদ্ধের পর এত বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়েও জার্মাানি আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। বিপ্লবের পর মুখ থুবড়ে পড়া ফ্রান্সকে নেপোলিয়ন আবার সগৌরবে মাথা উঁচু করাতে পেরেছিলেন এই জাত্যভিমানের কল্যাণেই।
আর ঠিক সেখানে আমরা কী করছি? ব্রিটিশদের প্রায় দু’শো বছরের শাসনে আমাদের আত্মমর্যাদার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে। তার পরের দু’যুগে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়েই আমাদের মাঝে সন্দেহ ঢুকে গেছে। পরের এই চার দশকেরও বেশি সময়ে আমরা না ঠিক করেছি আমাদের ভাঙ্গা মেরুদণ্ড আর না চিনতে শিখেছি নিজেদের ভাষা, কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে। চীন কিংবা জাপানের অর্থনৈতিক বিপ্লবের মূলমন্ত্র, ওরা ব্যবহার করেছে নিজেদের পণ্য। আর আমরা পারলে টয়লেট টিস্যুও বিদেশী কেনার চেষ্টা করি। অতঃপর, দেশের কেন উন্নতি হচ্ছে না এই নিয়ে সরকারের শাপশাপান্ত করি। নিজেদের বাঙালি পরিচয়কে ভুলে আমরা উন্নতি করতে পারব না কখনই। কখনই না।
এরই মাঝে যারা মধ্যযুগের ইসলামের ঐতিহ্যের কথা বলে সেই আদর্শে দেশ গড়ার কথা ভাবছেন, তাদের বলছি, তখন মুসলিম সভ্যতার একমাত্র মূলমন্ত্রও ছিল এই জাত্যভিমানও। তখনকার মুসলিম রাজ্যের সীমানা দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারবে, আসলে পুরোটাকে একটা দেশ হিসেবেই কল্পনা করা যায়, যার বাসিন্দাদের জাতীয়তা ছিল, ‘মুসলিম’। কিন্তু, বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এবং অন্তঃকোন্দলে জড়ানো মুসলমানদের নিয়ে এত বিশাল সমাজ সৃষ্টি অসম্ভব না হলেও তার খুব কাছাকাছি কিছু। তাই আমাদের চিন্তা করতে হবে নিজেদের নিয়েই।
আমরা বাঙালি, এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমাদের বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাড়াতে হবে বাঙালি পরিচয়েই। আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে বাঙালি পরিচয়েই। গ্রহণ করতে হবে নিজেদের পণ্য; নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে। নিজেদের পরিচয়কে ভুলে পরগাছার মত আমরা কখনই পারব না বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়াতে। আমাদের দেখাতে হবে, ষোল আনা বাঙালিয়ানা।
এবং সমস্বরে বলতে হবে, ‘তুমি কী? আমি কী? বাঙালি বাঙালি’।

ইস্টিশন ব্লগে পোস্টটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক