১৩ই শ্রাবণ

আকাশটার ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। আমার কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিল। মনে মনে আকাশটাকে একটা গালি দিলাম, ‘শালা বান্দর, তুই জানস না আমার ঘরের টিনের চাল ফুটা? তুই কান্দনের আর টাইম পাস না? আর কানবি তো কানবি আমার ঘরের উপরেই? দুনিয়ায় আর জায়গা নাই?’

পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম বান্দর সম্বোধনটা ঠিক হয়নি। বান্দর পুরুষ লিঙ্গ আর আকাশ ক্লীব লিঙ্গ। নাহ! বাংলা ভাষার ব্যাকরণে অসম্পূর্ণতা আছে। স্ত্রী আর পুরুষ লিঙ্গের মাঝেই প্রধানত রূপান্তর করা যায়। মাঝে মাঝে উভলিঙ্গতেও করা যায়। কিন্তু, ক্লীব লিঙ্গে কোন শব্দকে একেবারেই রূপান্তর করা যায় না। আচ্ছা বান্দরের ক্লীব লিঙ্গ কি হবে?

নাহ! মাথাটা জট পাকিয়ে আসছে। ক্লীব-বান্দর আমার ঘুম শেষ করতে দেয় নাই। এখন আবার একটু চেষ্টা করি ঘুমানোর… কালকে একটা বইয়ে পড়লাম, ‘মানুষ ঘুমানোর আগে যা ভাবে তাই স্বপ্নে দেখে।’ আচ্ছা, এখন যদি আমি নীতুকে কল্পনা করতে করতে ঘুমাই তাহলে কি স্বপ্নে নীতুকে দেখতে পাব? চেষ্টা করতে দোষ কি? না, চেষ্টা করতে দোষ আছে। এতক্ষন আমি ক্লীব লিঙ্গ নিয়েও চিন্তা করেছি। এখন যদি স্বপ্নে দেখি আমার সামনে ক্লীব নীতু দাড়িয়ে আছে! এক কাজ করা যায়। ঘুমানোর আগে আমি চিন্তা করব আমি ঘুমাচ্ছি। তাহলে স্বপ্নে দেখব, ‘আমি ঘুমাচ্ছি।’ সুপার আইডিয়া। আমার তো নোবেল পাওয়া উচিত।


আমি কি ঘুমিয়েছি? টিনের চালে প্রচন্ড শব্দে ক্লীব বান্দরের অশ্রু আছড়ে পড়ছে। শব্দটা বোধ হয় একটু বেশিই জোরে হচ্ছে। মনে মনে একটা ধমক দিলাম, ‘ওই আস্তে শব্দ কর।’ পরক্ষনেই মনে হল, আমি কাকে ধমক দিলাম? টিনের চালকে? শব্দ তো ওটাই করছে। কিন্তু তার জন্যে তো দায়ী আকাশটা। ওটা কাঁদছে বলেই তো শব্দটা হচ্ছে।

যদি আমি ঘুমিয়ে গিয়ে থাকি তাহলে এটা স্বপ্ন। তার মানে আমি স্বপ্নে নীতুকে দেখতে পাচ্ছি না। বেঁচে গেলাম! ক্লীব নীতু না জানি দেখতে কেমন হত!

ঘুমটা আর একটু গভীর করা দরকার। কাথাটা মুড়ি দিয়ে শু’লে কেমন হয়? হঠাৎ খেয়াল হল, আমি ঘুমানোর সময় কাথাটা গায়ে দিই নি। তাহলে? তার মানে এটা স্বপ্নই। ডান কাধটায় হালকা ব্যাথা লাগছে। বেশিক্ষন ধরে কি শুয়ে আছি? হতে পারে ঘুমের সময়, সময়ের আন্দাজ থাকে না। বা’দিকে ফিরে শু’লাম। চোঁখটা খুলে আবার ঠিকমত বন্ধ করতে যাব, তখন যা দেখলাম তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকল না যে আমি স্বপ্ন দেখছি। আমার সামনে নীতু দাড়িয়ে। হাসি চেপে রাখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও পারছে না।

‘হাসছ কেন?’ মোটামুটি বিরক্তিকর আনন্দের সাথে বললাম।
‘হাসছি কারণ, হাসলে শরীর সুস্থ থাকে, মস্তিষ্কে রক্ত-সঞ্চালন বাড়ে, আয়ু দীর্ঘ হয়, হৃদরোগ হয়না…’ স্বভাবসুলভ-ভাবেই কথাটা প্যাচাল এবং নিজের রসিকতায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে হাসতে থাকল।
‘আচ্ছা তুমি যখন মায়ে পেটে ছিলে তখন কি তোমার মা বেশি জিলাপি খেত?’
‘মনে হয়। আমি তো আর দেখি নি, আমার মা তখন কি খেত?’
অব্যার্থ উত্তর। তাই ওর ভেতর এত প্যাচ কেন তার কোন কুল-কিনারা আমি করতে পারলাম না। চুপ থাকলাম।

কিন্তু, নীতুর কাছে চুপ থাকার চেয়ে গলায় ওড়না দিয়ে ঝুলে পড়া সহজ। তাই ওই আবার শুরু করল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছ?’
‘কী?’
‘আমরা দু’জন তুমি করে কথা বলছি’।
‘স্বাভাবিক’।
‘ক্যান?’
‘শুন, স্বপ্ন কখনও ফিজিক্সের সূত্র মেনে চলে না। স্বপ্ন হল স্বপ্ন। আর যেহেতু আমি স্বপ্ন দেখছি তাই তোমাকে আমি তুমি করেই বলব, কারণ গার্লফ্রেন্ডকে তুই করে বললে পিরিত টিকে না’।
‘আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড!’
‘রিয়াল মাদ্রিদে থুক্কু রিয়াল লাইফে এখনও বলার সাহস হয়নি। কিন্তু, স্বপ্নে বলতে তো আর সমস্যা নেই’।
‘তুমি নিশ্চিত তুমি এখন স্বপ্ন দেখছ?’ 

নীতুর মুখে ফিচলে হাসি। আমি ভেতরে ভেতরে ভড়কে গেলাম। তবু, আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, ‘আমি যে এখন স্বপ্ন দেখছি তার সবথেকে বড় প্রমান হচ্ছে, আমি আমার নিজের ঘরে তোমার সাথে কথা বলছি।’ ঘরের চারপাশে একবার চোঁখ বুলিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম এটা আমারই ঘর। স্বপ্নে আবার কোথায় না কোথায় চলে যাই তার ঠিক নেই। তারপর আবার বললাম, ‘আর যদি এর চেয়ে বড় প্রমান লাগে তা হচ্ছে, আমি এখন আমার হাতে চিমটি কাটব এবং কোন ব্যাথা পাব না।’ একটু থেমে বললাম, ‘নাহ! তুমি চিমটি কাট। নাও।’ হাতটা বাড়িয়ে দিলাম।

নিতু উঠে আসল মুখে ফিচলে হাসি। সবসময়েই থাকে। তবু, আমি ভেতরে ভেতরে ভড়কে গেলাম। এসে আমার সামনে দাড়িয়ে হাতে এক রাম-চিমটি কাটল। আমি ব্যাথায় প্রায় লাফিয়ে উঠলাম।

নীতুর মুখ থেকে হাসি যেন উপচে পড়ছে। ওকে দেখে আমার গা জ্বালা করতে লাগল। এরকম একটা বদ মেয়ের প্রেমে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি! না, আমি সাতার জানি। এই রকম একটা বদ মেয়ের প্রেমে আমি সাতার কাটছি!কথা হচ্ছে না দেখে ওই আবার শুরু করল, ‘এই আজকে তারিখ কত?’
‘অগাস্টের ৬, ক্যান?’
‘উহু! বাংলা তারিখ’।
‘জানিনা। ক্যান? তোমার কি করতে লাগবে?’
‘আজকে বাংলা ১৩শে শ্রাবণ। আমার জন্মদিন’।

১৩শে শ্রাবণ নীতুর জন্মদিন এটা কি নীতু আমাকে বলেছে? আমি না জানলে তো সেটা স্বপ্নে দেখা সম্ভব না। হয়তো বলেছিল। স্মৃতির কোন কোণায় জমা হয়ে ছিল। আজ আবার সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে এসছে। নীতু তখনও বকবক করে চলেছে, ‘আমার যেদিন জন্ম, সেদিনও তুমুল বৃষ্টি। তা দেখে আমার দাদী আমার নাম রেখেছিল শ্রাবণী। আমার পুরো নাম জান তো? শ্রাবণী মজুমদার নীতু। এরপর থেকে আমি যে কয়টা জন্মদিন পালন করেছি, প্রত্যেকটায় বৃষ্টি হয়েছে। কেন এমন হয় বলো তো! আচ্ছা তুমি কি জান আমার বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভাল লাগে? আমার শেষ ইচ্ছে কি জান? আমার মৃত্যু হয় যেন ১৩শে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে…’

তন্ময় হয়ে ওর কথাগুলো শুনে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল দেবলোক থেকে কোন এক অপ্সরা দৈবক্রমে নেমে এসে আমাকে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে।

‘এই আমার এই বকবকানি শুনতে তোমার খুব খারাপ লাগছে না? কি করব বল। আমার সারাক্ষন বকবক করার অভ্যাস। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। আর কখনও দেখা হবে কি’না জানি না। দেখেছ আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। অঝোর। আমার খুব ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে। ১৩শে শ্রাবণের বৃষ্টি। আসি। তোমাকে আর বিরক্ত করব না।আমি যে ন মন্ত্রমুগ্ধের মত কথাগুলো শুনে গেলাম। নীতু ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। এর চেয়ে সুন্দর স্বপ্ন কি আমি আগে কখনও দেখেছি? বোধ হয় না।

আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। অঝোর। টিনের চালে বৃষ্টিগুলো আছড়ে পড়ছে। টিনের চালের ফুটো দিয়ে কখনও আমার দেহে কোন এক ফোটা পড়ছে। মুহুর্তে সমস্ত মন ভরে যাচ্ছে প্রশান্তিতে। এক মুহুর্তে মন হল এই পৃথিবীতে সবচেয়ে পবিত্র বস্তু হচ্ছে বৃষ্টি। ১৩শে শ্রাবণ তার মাঝে সুন্দরতম। জানাল দিয়ে বাইরে তাকালাম। বৃষ্টিস্নাত গাছগুলো যেন আমাকে দেখছে। ঘরটা এক অপূর্ব সুঘ্রাণে ভরে উঠেছে। পার্থিব কিছুর সাথে তার জুড়ি মেলা ভার।চোঁখটা ভালভাবে খুলে বন্ধ করে নিলাম। ১৩শে শ্রাবনের বৃষ্টিটাকে দু’চোঁখে ভরে এক পলক দেখে নিলাম। নীতুকে দেখার পর সবকিছুকেই ভাল লাগে।

==========================================================

‘দাদা, এই দাদা আর কত ঘুমোবি? এবার ওঠ’ ঐশি-আমার ছোট বোনের গলা।‘
এই সর বিরক্ত করিস না’ একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়ল আমার কন্ঠ থেকে।
‘উঠবিনা তুই? মাকে বলব তুই সন্ধে পর্যন্ত ঘুমোচ্ছিস?’অগত্যা উঠতে হল।

চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলাম। ঐশি আমার পাশে এসে বসল। বুঝলাম কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু একটু আগে আমার সাথে যে পরিমান শত্রুতা করেছে তাতে কথা শোনার প্রশ্নই আসে না। উঠে উঠোনে গিয়ে দাড়ালাম। কিন্তু ঐশি আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললাম, 'কিরে! কিছু বলবি?'
‘জানিস দাদা আজকে কি হয়েছে? পুবপাড়ার নীতুবুবুকে তো চিনিস। আজকে দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজছিল। হঠাৎ রইচদের বাড়ির কালো ষাড়টা যেন কোথা থেকে এসে ওকে গুতো দেয়। মারাত্মক জখম হয়েছে। সদরে নিয়ে গেছে। মনে হয় বাঁচবে না’।

আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। তাহলে আমি স্বপ্নে কার সাথে কথা বললাম? ওটা কি স্বপ্ন ছিল? না’কি বাস্তবতা? ২২শে শ্রাবণের পরাবাস্তব স্মৃতি।


Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক