লজ্জা

আমি আজকে তোমাকে মানুষের কথা বলব,
আমি জানি,
কথাগুলোর শোনার কোন ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা তোমার নেই।
তবুও বলব।
মানুষগুলোকে তোমরা যে নামে ডাকো তা আমার পছন্দ নয়।
আমি ওদের বাঙালি বলতেই ভালবাসি।
যদিও তোমরা তাদের সেই নামে ডাকো না।
তোমরা ওদের সংখ্যালঘু বলে ডাকো।
শুনলে মনে হয়,
‘ওরা বাঙালি নয়। অন্য কোন জাতি!’


যাই হোক। বাদ দাও।
কথা ঘুরে যাচ্ছে।
আমি আজকে তোমাকে কিছু ইতিহাস শোনাব।

আমি জানি,
ইতিহাসটুকু শোনার কোন ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা তোমার নেই।
তবুও শোনাব।
অবশ্য সাধারণ ঘটনাগুলো,
ঠিক কখন থেকে ইতিহাসের অংশ হতে শুরু করে আমার জানা নেই।
আমার এও জানা নেই, আমার ক্লাসরুমে ঘটা কোন ঘটনা
কিংবা কোন ঘটনাপ্রবাহ কখনও ইতিহাসের অংশ হতে পারে কি’না?
কিন্তু, আমার কাছে তা ইতিহাস।
লজ্জার, প্রচণ্ড এবং অসহনীয় লজ্জার ইতিহাস।
যা মনে পড়লে আমার এখনও লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে।


আমি সেই ইতিহাসের কথা শোনাব,
যখন আমি শুনতে পেতাম আমাদের ইসলামিয়াতের শিক্ষক
ক্লাসে সবাইকে ভ্রাতৃত্ব শেখানোর বদলে
প্রতিটি ক্লাসে কতটা তীব্রভাবে আক্রমণ করত হিন্দুদের।
এবং বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান...
দুঃখিত, সংখ্যালঘুদের।
‘ওরা কাফের, ওরা ফাসেক।
ওরা আমাদের দুশমন
এবং...’ থাক সব সেই পুরনো একই কথা।
সাতচল্লিশ থেকে শুনে আসছি।


আমি শুধু সেটুকু বলি। আমার অনুভূতিটুকুর কথা।
আমি জানি,
কথাগুলোর শোনার কোন ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা তোমার নেই।
তবুও বলব।
আমি তা শুনে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম।
‘আমি সংখ্যাগুরু’ এই তীব্র লজ্জা আমায় আচ্ছন্ন করত।
আমি ভয়ার্ত চোখে ক্লাসের ‘সংখ্যালঘু’দের দিকে তাকাতাম।
ভাবতাম, না’জানি কতটা দ্বেষ, ঘৃণা আর ক্রোধ দেখব সেখানে।
আমি কিছুই দেখতাম না।
মৃতের মত নিঃস্পৃহ থাকত ওরা।
এবং লজ্জায় আমার আত্মার মৃত্যু ঘটত।


আমি চিৎকার করে বলতে চাইতাম-
স্যার,
আপনি কি ইসলাম শব্দটার অর্থ জানেন?
ইসলাম মানে যে শান্তি, সেই শান্তির অর্থটা কি আপনি জানেন?
কোনদিন অনুভব করার চেষ্টা করছেন,
শান্তি কী? শান্তি কেমন? শান্তি কেন?
শান্তি মানুষের জন্য।
মানুষ ধর্ম এনেছে, ধর্ম মানুষ নয়।
স্রষ্টা মানুষের জন্য ধর্মকে সৃষ্টি করেছে,
ধর্মের জন্য মানুষকে নয়।
কথাগুলো কখনও ভেবেছেন?
কখনও কি ভেবেছেন স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষকে হত্যা করে,
কোন স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পন করবেন?
চব্বিশটা বছর এই সাম্প্রদায়িকতার গ্লানি মেখে বেঁচেছি।
আর কত?


একাত্তরের হানাদাররা যেমন মুসলিম ছিল,
মুক্তিযোদ্ধারাও তাই ছিল।


সেই সাতচল্লিশ কিংবা তারও আগে ১৯০৫ থেকে শুনে আসছি,
সেই একই ভাঙ্গা রেকর্ড!
আর কত?
ওদের একমাত্র পরিচয়, ওরা মানুষ। ওরা বাঙালি।


বলতাম না।
বলতে পারতাম না।


আমি জানি,
কথাগুলোর শোনার কোন ইচ্ছে বা আকাঙ্ক্ষা তোমার নেই।
তবুও বলব।
তুমি কি জানো?
যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে নিয়ে আমার এতটা গৌরব,
সেখানে, মানুষ হত্যার সার্টিফিকেট দেয়া হয়। কারণ,
সে অমুসলিম?
তুমি কি জানো? ধর্মের নামে মানুষ হত্যা এখানে জায়েজ!
তুমি কি কখনও চিন্তা করতে পারো?
এখানে ধর্মের কারণে, মানুষকে গৃহহীন করে
মানুষেরাই উল্লাসে মেতে ওঠে?
তুমি কি জান?
‘যুদ্ধের সময় ধর্ষণ জায়েজ’ বলে এখানে ফতোয়া দেয়া হয়।
সেই ফতোয়া মেনে মানুষ ধর্ষণের উৎসব করে।
তুমি কি জান?
ত্রিশ লক্ষ মানুষের হত্যাকারীকে রক্ষার জন্য এখানে আন্দোলন হয়!
এবং বেজে ওঠে, সেই একাত্তরের পুরনো রেকর্ড।
ওরা হিন্দু।
ওদের হত্যা জায়েজ।


এসব আমার কাছে কিছুই নয়।
সেই জন্মলগ্ন থেকে শুনে আসছি।
এখন আর কোন অনুভূতি জাগে না এ নিয়ে।
আমার অনুভূতি জাগে তখন, যখন আমার মনে পড়ে
সেই কথিত সংখ্যালঘুর নিঃস্পৃহ দৃষ্টি।
যেখানে আমি অনেক খুঁজেও হিংসা, দ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ কিছুই পাইনি।
অনেক খুঁজেছি।
পেয়েছি শুধু অসহায়ত্ব।
সেই অসহায়ত্বই

আমার সংখ্যাগুরু হবার গৌরবকে ধূলিসাৎ করতে যথেষ্ট।

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক