চেনা অচেনা আলো আঁধারে
(১)
বিকেল থেকেই টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের অবস্থা ভাল না। যে কোন সময় হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি পড়তে শুরু করবে। বেশিভাগ লোকজনই টি.এস.সির ভেতরে কিংবা কোন টংয়ের দোকানের নিচে মাথা লুকিয়েছে। শুধু নীলার মত হাতে গোনা কয়েকটা বৃষ্টিবিলাসী এখনও টি.এস.সি.র মোড়েই বসে আছে। নীলা এক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে। বাকিরা বসে আছে কোন একটা গাছের তলায়। নীলা বসেছে রাজু ভাস্কর্যের নিচে। অনন্ত আকাশের নীচে মাথা লুকিয়ে। অবশ্য নীলা মোটেই কোন বৃষ্টি বিলাসী মেয়ে না। এভাবে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটাকে তাকে ছোয়ার অধিকার দেয়ার কারণ ভিন্ন। নীলা কাঁদছে। সেই কান্নার জল লুকোতে নীলা তাকে মিশিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির সাথে।
সূর্যটা লাল হয়ে আসায়, তার আভা পড়েছে মেঘগুলোতে। রক্তলাল মেঘ। আর কিছুক্ষণ পরই আজান দেবে। নীলার সামনে একটা পেপারে ছোলা, বুট, মুড়ি, পেয়াজু, বেগুনী সাজিয়ে রাখা। দু'জনের খাবার। সেগুলোও ভিজছে। সোহেল চলে গেছে অনেকক্ষণ হল। তবু, নীলা হাকিম চত্বরের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতিবার মনে হচ্ছে এখনই বুঝি সেখান থেকে সোহেল দৌড়ে আসবে। এসেই স্থান-কাল-পাত্র না ভেবে তাকে জড়িয়ে ধরবে। বলবে, “নীলা, আমি যা বলেছি মিথ্যে বলেছি। তোমাকে আমি যতটা ভালবাসতাম, এখনও ঠিক ততটাই বাসি। আমি জানি আমার সাথে প্রতারণা করার মত মেয়ে তুমি নও। তুমি আমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালবাস। যতটা আমি তোমাকে বাসি, ঠিক ততটাই।”
নীলা তাকিয়ে আছে। কেউ আসছে না। কেউ না।
লালচে মেঘগুলো সরে গেল আরও উত্তরে। সেদিক থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এল। সবাই সাথে সাথে হুড়মুড়িয়ে পড়ল ইফতারের দিকে। সারাদিনের অভুক্ততা এখন আধ ঘণ্টায় শেষ করতে হবে। অন্য কোন দিকে তাকানোর হুশ নেই। প্রিয় সঙ্গীনীটিকে মাঝে মাঝে “অ্যাই, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না” বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার নিজের খাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়া গেলেও, রাজু ভাস্কর্যের নীচে একটা মেয়ের চোখে অঝোর বর্ষনের এক আকাশ মেঘের দিকে মনোযোগ দেয়ার মত সময় কারও ছিল না।
(২)
ঘরটা প্রায় পুরোপুরি অন্ধকার।
ঈশান কোণের ঘুলঘুলিটা দিয়ে খানিকটা হলুদ আলো চুপিসারে আছড়ে পড়ছে রাস্তার সোডিয়াম লাইট থেকে। এই আলোতে কিছু দেখতে হলে রীতিমত বিড়ালোর চোখ দরকার। অথচ এই আলোতেই দিব্যি ভদকা খেয়ে চলেছে লৌকিক। এটা দ্বাদশ পেগ। তার লিমিট দ্বাদশ পেগ পর্যন্তই। ত্রয়োদশ পেগ ঢালতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। লৌকিক উঠল না। এই পেগটা শেষ করে, গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখল সশব্দে। কণ্ঠনালী দিয়ে ঝাঝাল একটা স্রোত নিচে নেমে গেল। প্রায় সাথে সাথে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা তীব্র অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌছে গেল। মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে প্রচণ্ড জোরে ভাপ বের হয়ে, করোটিতে সজোরে আঘাত করছে। একটু পর সেই দপদপানি কমে গিয়ে, তার চেতনায় বিচ্ছিন্নতা ভর করতে শুরু করল। লৌকিক প্রায় নিঃশব্দে বলল, “ধরেছে।”
ধীর পায়ে গিয়ে দরজার কাছে দাড়াল। ছিটকিনি ধরে দরজা খোলার চেষ্টা করল। পারল না। শুধু অনিয়ন্ত্রিতভাবে হাতটা দরজার ওপর পড়া রাতের নিঃশব্দতা ভেঙ্গে একটা শব্দ হল। সামনের রাস্তাটায় পরম নির্ভয়ে ঘুমিয়ে থাকা কালো কুকুরটায় ঘুমে তাতে খানিকটা ব্যঘাত ঘটল। সে আধো তন্দ্রায় কুই কুই করে খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। তবে, দরজার ওপাশে কোন বিরক্তি দেখা গেল না। সম্ভবত সে এর সাথে অভ্যস্ত।
বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় অবশেষে লৌকিক দরজা খুলতে পারল।
চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় একটা মেয়ের অবয়ব দেখা গেল। চেনা গেল না ভাল মত। লৌকিক দরজার সামনে থেকে সরে দাড়াল। মেয়েটা প্রায় নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল। রাত একটার নিঃশব্দতা তার চেয়েও প্রকট হওয়ায় খানিকটা হাই হিলের শব্দ পাওয়া গেল।
দেয়ালে হাতড়ে সুইচ অন করতেই সারা ঘরে ১০০ ওয়াটের বাল্বের আলো ছড়িয়ে পড়ল। নীলা হাত দিয়ে দু'চোখ ঢাকল। লৌকিক সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করল না। সে লাথি দিয়ে টেবিলটা একপাশে ফেলে দিল। কাচের গ্লাসের ভেঙ্গে যাবার ঝনঝন এবং ভদকার প্লাস্টিকের বোতলের টকটক মিলে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করল। লৌকিক মুগ্ধ হয়ে খানিকক্ষণ সে আওয়াজ শুনল। তারপর সেটা মিলিয়ে গেলে ঘরের কোণায় ফেলে রাখা স্টান্ডটা দাড় করাল। এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তুলিগুলো সব একসাথে জড় করল। তিসির তেলের বোতলটা খুঁজে পেতে খানিকটা সমস্যা হল। একটু আগে লাথি দিয়ে ফেলে দেয়া টেবিলটা আবার এনে পাশে সোজা করে রাখল। তার ওপরেই রং ঠিক করল। কাঁপা কাঁপা হাতে রংগুলো একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে গেল। তিসির তেলের বোতল হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভাঙ্গি ভাঙ্গি করেও ভাঙ্গল না। সেটা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা দেখা গেল না। তারপর হঠাৎ করেই খেয়াল করল, তার পেছনে নীলা এখন ঠায় দাড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে বলল, “নগ্নবক্ষা।” তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল।
নীলা একবার পাশের বিছানাটার দিকে তাকাল। পৃথিবীর সবচেয়ে এলোমেলো ঘরগুলোর একটায় এমন সাজানো গোছানো একটা বিছানা ঠিক মানায় না। তারপর কথামত নগ্নবক্ষা হয়ে সন্তর্পনে বিছানায় শুয়ে পড়ল। লৌকিক সব গুছিয়ে নিয়ে নীলার দিকে তাকাল। তারপর তার কাছে গিয়ে, তার শাড়ির আচলটাকে ঘাড়ের ওপর দিয়ে নিয়ে পেছনে খানিকটা ছড়িয়ে দিল। চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো করে কিছুটা ডান স্তনের ওপর ছড়িয়ে দিল।
লৌকিক আবার এসে তার কাজে মন দিল। কাল এই ছবিটা ডেলিভারি দিয়েই একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে হবে। কোথাও যাওয়ার কথা। কিন্তু, কোথায় যেতে হবে, ঠিক মনে পড়ছে না। সময় হলে ঠিকই মনে পড়বে।
নীলার পুরো শরীরটার দিকে একবার তাকালো। পুরো কাঠামোটা মস্তিষ্কের মাঝে সংরক্ষণ করে রাখল। তারপর তুলি ধরল। কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যানভাসে একের পর এক আঁচড় পড়তে থাকল। সাদা ক্যানভাস ভেদ করে একটু একটু করে ফুঁটে উঠতে শুরু করল এক রমনী।
নীলা পাথরের মূর্তির মত শুয়ে আছে। যেন শরীরের প্রাণের কোন অস্তিত্ব নেই। সে যে জীবন্ত মানবী, তার প্রমান শুধু দিয়ে যাচ্ছে, তার বা চোখ থেকে পড়তে থাকা ছোট্ট একটা জলধারা। নীলা কোথায় যেন পড়েছিল, নগ্ন তরুণীকে দেখে যার মাঝে যৌন বাসনার উদ্রেক হয় না, সে মানসিকভাবে অসুস্থ। আচ্ছা, লৌকিক কি মানসিকভাবে অসুস্থ? প্রায় দুই বছর ধরে সে লৌকিকের মডেল হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। কখনও তার শরীরের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখতে পায়নি। এত অসাধারণ প্রতিভা, অথচ থাকে এই দোতলা বিল্ডিংয়ের ঘুপচি ঘরের মত চিলে কোঠায়। নীলার মাঝে মাঝে মনে হয়, তার এই উশকো খুশকো চুল যদি কেউ সুন্দর করে আচড়ে দিত, তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি শেইভ করিয়ে সুন্দর একটা শার্ট পরিয়ে দিত, তবে তাকে সুদর্শনই মনে হত। কিন্তু, তাকে দেখতে কেমন লাগছে, এ নিয়ে কোন মাথা ব্যথা তার নেই। তার আঁকা প্রতিটা ছবিই মাস্টারপিস। অথচ, তা কখনও কোন প্রদর্শনীতে যায় না। নীরবেই কোন বিত্তশালীর বেডরুম সাজাতে চলে যায় সেই নগ্ন নারীর পোট্রেট। আর তা থেকে যে টাকা আসে, তা চলে যায় ভদকার পেছনে। মানুষটাকে আসলেই সুস্থ? মনে হয় না।
তার বা চোখের অশ্রুটুকু শুকিয়ে আসে। এবার ডান চোখ কাঁদতে শুরু করে। মনে পড়তে শুরু করে সোহেলের কথা। সোহেল কি আর কোন দিন তাকে বিশ্বাস করবে? করার তো কারণ নেই। সে একটা বাজে মেয়ে। একটা বাজে মেয়েকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। সোহেল বুঝবে না, সে বাজে মেয়ে না হলে তার শহরে পড়ার খরচ জোগানো যেত না। সে বাজে মেয়ে না হলে মাসে মাসে সে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারত না। বুঝবে না, বাজে মেয়ে না হলে তার বেঁচে থাকাই হত না। সে শুধু বুঝবে নীলা একটা বাজে মেয়ে।
অবশ্য সোহেলের সাথে সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার দিনই কাকতালীয়ভাবে একটা ঘটনা ঘটেছে। গ্রামের বাড়ি থেকে খবর এসেছে, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তার বাবা এসে বলে গেছে। মেয়ের কাছে হাউমাউ করে কেঁদে বলেছে গ্রামের চেয়ারম্যানের বাড়ির প্রস্তাব। না বলা অসম্ভব। নীলা কিছু বলে নি। শুধু দু'ফোটা অশ্রু দিয়ে বাবাকে বিদায় করেছে। কালই গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা দিতে হবে। আচ্ছা, বিয়ের পর কি সে একটা ভাল মেয়ে হতে পারবে? তার দু'চোখ দিয়ে আরও দু'ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
লৌকিক অবাক হয়ে খেয়াল করল, তার মৃত ক্যানভাসে ফুঁটে ওঠা জীবন্ত নারীর চোখে দু'ফোটা জল। অবাক হয়ে সে নীলার চোখের দিকে তাকাল। সেখানেও জল।
(৩)
শাহেদ বিরক্ত মুখে বসে আছে। একটু পর পর ব্যস্ত ভঙ্গিতে একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর একবার সামনে তাকাচ্ছে। ইফতারের আর এক ঘণ্টা বাকি। ভেবেছিল গ্রামের বাড়িতে পৌছে, সেখানেই ইফতার সারবে। সেটা আর বোধ হয় হচ্ছে না। জেলা শহরে পৌছাতেই আরও আধ ঘণ্টার মত লাগবে। সেখান থেকে তাদের বাড়িতে পৌছাতে আরও আধ ঘণ্টা। যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে কেয়ামতের আগে বাস ঠিক হবার কোন লক্ষণ নেই। শাহেদ ঠিক করেছিল, ঢাকা থেকে রওনা দেবার পর আর মেজাজ খারাপ করবে না। কিন্তু, অবস্থা যা দেখা যাচ্ছে, তাতে মেজাজ ভাল রাখা দায়।
শাহেদ বিরক্ত গলায় হেল্পারকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই বাস কি ঠিক হবার কোন চান্স আছে?”
হেল্পার সেটা শুনল কি'না বোঝা গেল না। তাকে মাছি তাড়াতে ব্যস্ত দেখা গেল।
শাহেদ বাস থেকে নামল।
ইন করা শার্ট ছেড়ে দিয়ে সামনে তাকাল। কিছুটা পাকা রাস্তা। তারপর ঘাস। ঘাস পেরিয়ে গেলেই বিশাল ধানখেত। মাত্র আমনের চারা লাগিয়েছে। কচি সবুজ রং। সেই রং দিগন্তের দিকে যত এগিয়েছে তত গাড় হয়েছে। একেবারে দৃষ্টির শেষ সীমায় দেখা যায় একটা গাছ। সম্ভবত বট গাছ। তার বিশালতার সামনে আর কোন গাছ মাথা তুলে দাড়ানোর সাহস পায় নি।
এক নিমিষে শাহেদের মন ভাল হয়ে গেল। ঢাকায় ইট-কাঠ-পাথরের শহরে কতদিন এমন সতেজ সবুজ দেখা হয় নি কে জানে? নটা-পাঁচটা যন্ত্রের মত কাজ করে সে নিজেও বোধ হয় যন্ত্র হয়ে গেছে। ধীর পায়ে শাহেদ ধান খেতের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। মেজাজটা এখন ভাল মনে হচ্ছে। আর একটু ভাল কীভাবে করা যায়? তার বিয়ের কথা ভাবলে কি মেজাজ ভাল হবে? হবার কথা। বিয়ের আগ পর্যন্ত বিয়ের কথা মনে করলে মন মেজাজ ভাল হয় না, এমন ছেলে জগতে দুর্লভ। শাহেদের বিয়ে ছয় দিন পর। আগামী শুক্রবার। জুমাতুল বিদায়। অতি শুভ দিন। অতি শুভ দিনে অতি শুভ একটা কাজ সম্পন্ন হবে।
মেয়েকে এখনও শাহেদ দেখে নি। তাদের রক্ষনশীল পরিবার। বিয়ের আগে ছেলে মেয়ের মুখ দেখাদেখি হবে না। শাহেদ মনে মনে হাসল। অথচ সে ঠিকই ভার্সিটিতে পড়েছে। শুধু মুখ দেখাদেখি নয়, পাশাপাশি বসে পড়াশোনাও করেছে। অফিসে একসাথে নারী কলিগদের সাথে কাজ করছে। তার বাবা যদি স্রেফ একদিন ঢাকায় এসে সারাদিন তার ছেলের সাথে থাকত...। শাহেদ হেসে ফেলল। অবশ্য মেয়েও না'কি ঢাকাতেই থাকে। নামটা কী যেন? ও হ্যাঁ, নীলা। সুন্দর নাম। শাহেদ ভেবেছিল, একবার লুকিয়ে দেখা করবে। পরে আর করে নি। মেয়েদের পেটে না'কি কথা থাকে না। বিয়ের আগে বা পরে একবার ফাঁস করে দিলে, শাহেদের বাবা তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। অবশ্য এই ক'দিনে শাহেদের মাথায় ঢোকে নি ঢাকায় থাকা একটা মেয়ে, ছেলেকে না দেখেই বিয়েতে কীভাবে রাজি হয়ে গেল?
কীভাবে রাজি হল, সেটা নিয়ে শাহেদ বেশি ক্ষণ ভাবার সময় পেল না। পেছন থেকে হেল্পারের গগনবিদারী চিৎকার শোনা গেল, “বাস ঠিক হয়া গ্যাছে। সবাই ইফতার কিইন্যা বাসে ওঠেএএএন।”
শাহেদ কী ভেবে দু'টো ধানের ডগা ছিড়ে নিয়ে গালে ছোয়ালো। তারপর বাসের দিকে পা বাড়ালো।
(৪)
বেশ নীরব; নিঃশব্দ।
ক্ষণিক আগ পযন্ত চলা উৎসবের রেশ এখনও খানিকটা রয়ে গেছে। একটু পর পর এখানে সেখানে খানিকটা কোলাহলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তবে, সবাই ক্লান্ত। কোথাও কোলাহল বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছে না।
শরাফত আলী মোল্লা বারান্দায় জল চৌকিতে বসে পান চিবোচ্ছেন। তার মুখ হাসি হাসি। তার বড় ছেলে আবদুশ শাহেদ মোল্লার বরযাত্রী কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে। ভেতরে মেয়েরা হাসাহাসি করছে। অন্য কোন দিন হলে তিনি ধমক দিতেন। মেয়ে মানুষের গলার আওয়াজ বেগানা পুরুষ শুনলে পাপ হবে। আজ দিলেন না। করুক খানিকটা।
শাহেদ আড়ত ঘরের পাশে বন্ধু বান্ধবদের সাথে সিগারেট টানছে। হঠাৎ, কোত্থেকে তার এক দুঃসম্পর্কের ফুপি এসে বলল, “এইখানে দাড়াইয়া আর কত আজাইরা সুময় নষ্ট করবি? ভেতরে বউডা একলা একলা বইয়া আছে একটু গেলেও তো পারস।”
শাহেদ মুখে লজ্জা পাওয়ার ভান করলেও ভেতরে বেজায় খুশি হল। এতক্ষণ এটাই ভাবছিল। কেউ ডাকতে আসছিল না বলে বিরক্তও হচ্ছিল। বিয়ের মাঝে একবার চক্ষুলজ্জা ত্যাগ করে, সরাসরি বউয়ের দিকে তাকিয়েছিল। সেই চেহারা দেখে মনে হয়েছে, সে সারাজীবন শুধু এই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে। শাহেদ দ্রুত পায়ে বাসর ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
(৫)
নীলা চুপচাপ বসে আছে। বাইরে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। শুনতে খারাপ লাগছে না।
সে এখণ বসে বসে কল্পনা করার চেষ্টা করছে, শাহেদের চেহারা কেমন হতে পারে? বিয়ের সময় আড় চোখে দু'একবার দেখার চেষ্টা করেছে। ভাল মত পারে নি। তবে পাশ থেকে আধো চেহারা দেখে কেন যেন বড্ড পরিচিত মনে হয়। মনে হয়, এ তার কত দিনের আপনজন। আচ্ছা, বিয়ের পর সে কি পারবে, সোহেলকে ভুলে সবকিছু নতুন করে শুরু করতে? কেন পারবে না? সোহেল যদি তাকে ছেড়ে বেঁচে থাকতে পারে, তবে সে কেন পারবে না?
নীলা কল্পনা করছে, একটা ছোট্ট ছিমছাম বাসা। শাহেদ অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরবে। ফিরেই হাত-পা চেয়ারে এলিয়ে দেবে। নীলা গাড় লিকারে এক কাপ চা করে নিয়ে যাবে। শাহেদ চা নেয়ার ভান করে নীলার হাত ধরে টান দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করবে। নীলা লজ্জা পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নেবে।
নীলা হেসে ফেলল। লজ্জা! সে টানা দু'টো বছর প্রতি শুক্রবার রাতে একজন মানুষের সামনে নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকত। তার আবার লজ্জা! নীলার চোখে এক আকাশ বিষাদ ভর করল। শাহেদ যদি কোনদিন তার অতীত জানতে পারে, সে কি নীলাকে ক্ষমা করবে? না'কি সোহেলের মত সেও তাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলবে?
হঠাৎ, দরজার কপাট দু'টো নড়ে উঠল। নীলা চোখ দু'টো লজ্জায় ডুবিয়ে গভীর উৎকণ্ঠা মাখিয়ে সেদিকে তাকালো। তার কল্পনার সাথে শাহেদের মিল কতটুকু?
শাহেদ ঢুকেই থমকে দাড়ালো। দু'চোখ ভরে দেখতে লাগল নীলাকে।
নীলা অবাক হয়ে দেখল, তার সামনে লৌকিক দাড়িয়ে আছে। প্রথমে ভাবল, সারাদিনের ধকলে চোখে ভুল দেখছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখল। না এ লৌকিক। নিজেকে আবার বোঝাল। লৌকিক একজন আর্টিস্ট। সারাক্ষণ ভদকার নেশায় ডুবে থাকে। শাহেদ চাকরী করে। ভাল ঘরের একটা ভদ্র ছেলে। আবার তার মুখের দিকে তাকাল। লৌকিকের চুলটা সুন্দর করে আচড়ে দিলে, একটা পাঞ্জাবী পরিয়ে মুখে একটা হাসি ফুঁটিয়ে দিলে কেমন লাগবে? হ্যাঁ এ লৌকিক। কিন্তু, কীভাবে? নীলার হঠাৎ করেই মনে পড়ল, শুক্রবার ছাড়া আর কখনও লৌকিকের সাথে তার দেখা হয় নি।
নীলা সহ্য করতে পারল না। মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
শাহেদ কিছুই বুঝতে পারল না। হঠাৎ করেই তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে দেখল। কয়েক মুহূর্ত কিং কর্তব্য বিমূড় থেকে জোরে ডাকল, “বাবা, এদিকে এসো।”
মোল্লা বাড়িতে আবার কোলাহলের শব্দ পাওয়া গেল।
(৬)
নীলা কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ড. রহমান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। নীলা চোখ মুছল। বলল, “আমি জানি না, কোনটা সত্যি? কে সত্যি?”
-এরপর আর লৌকিকের সাথে দেখা করেছিলে?
-গিয়েছিলাম। পাই নি। অবশ্য সেদিন রবিবার ছিল। আর শুক্রবার ছাড়া কখনও তার সাথে আমার দেখা হয় নি। এমন হতে পারে, শুক্রবার ছাড়া সে সেখানে থাকে না।
-এই ক'দিনে শাহেদের মধ্যে তুমি কোন অস্বাভাবিকতা দেখেছ?
-না। দেখি নি। দেখি নি বলেই বোধ হয়, আমি আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেছি। বিয়ের পর থেকে আজ চার দিন হল, আমি এক ফোঁটা স্বস্তি পাই নি। ভেবেছিলাম, ঢাকা এলে হয়তো দেখা যাবে শাহেদ আসলে লৌকিক। কিন্তু, ঢাকায় এসে দেখছি, সে দিব্যি অফিস করছে। কাল তার সাথে আমি তার অফিসেও গিয়েছি। সে সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সে সত্যিই শাহেদ।
-মনে হচ্ছে, সে শাহেদ না হলে লৌকিক হলেই তুমি বেশি খুশি হতে!
-বোধ হয় তাই। যদি এমন হত, শাহেদ আসলেই লৌকিক। আমাকে মিথ্যে জানিয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছে, তাহলেও পরিস্থিতিটা বোধ হয় এতটা যন্ত্রণাদায়ক হত না। লৌকিককে আমি চিনি। ভদকার কথা বাদ দিলে তার মত মানুষ হয় না। কিন্তু, লৌকিকের সাথে শাহেদের আচরণের বিন্দুমাত্র মিল নেই। দু'জন পুরোপুরি আলাদা দু'টো মানুষ। অথচ তাদের চেহারায় এত মিল। দেখে মনে হয় জমজ ভাই।
ড. রহমান হেসে ফেললেন, “বাংলা সিনেমা দেখার অভ্যাস আছে না'কি? দুই জমজ ভাইয়ের একজন ছোট বেলায় হারিয়ে গিয়েছিল!” তিনি হা হা করে হাসতে লাগলেন।
নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি জানি না। আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি না বলেই আপনার কাছে এসেছি।”
ড. রহমান কোন উত্তর দিলেন না। চুপ করে কল্পনায় পাজল মেলাতে শুরু করলেন। একটার পাশে আর একটা ঘটনাকে বসিয়ে দেখতে লাগলেন মেলে কি'না? একটা ঘরে এসে আটকে গেলেন। কিছুতেই মিলছে না।
নীলাকে বললেন, “আগামী শুক্রবার শাহেদকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারবে? রাত দশটার দিকে?”
নীলা বলল, “হ্যাঁ, পারব।” সাথে সাথেই আবার দ্রুত বেগে মাথা নেড়ে বলল, “না না, সম্ভব না। ওকে আমি কী বলে আনব?”
-বলবে, তোমার এক বান্ধবী বলেছে বিয়ের পর বাবা মায়ের থেকে দুরে চলে এসেছ বলে, মানসিকতার ওপর চাপ পড়েছে। তাই সেদিন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে। এখনও সবসময় অন্যমনষ্ক হয়ে থাক। তাই কোন সাইকিয়াট্রস্টের কাছে কাউন্সেলিং করালে ভাল হয়। শাহেদ লেখা পড়া জানা ছেলে। বুঝবে।
-হ্যাঁ, আমি চেষ্টা করব।
-তাহলে সেদিনই আমার সাথে দেখা কর।
নীলা চেয়ার ঠেলে উঠে দাড়াল।
(৭)
নীলা হসপিটালের গেইটের সামনে যেতেই হর্নের আওয়াজ শুনল। জানালা দিয়ে মাথা বের করে ড. রেহমান বললেন, “এদিকে এসো।”
নীলা আর শাহেদ সেদিকে এগিয়ে গেল। ড. রহমান গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। দু'জনকে বললেন, “আশা করি, নীলা আর শাহেদ?”
দু'জনেই মাথা নাড়ল।
-আচ্ছা, আজকের লাস্ট কেস এটা। ভাবছি, ঢাকার রাস্তায় একটা লং ড্রাইভ দিতে দিতে কেসটা হ্যান্ডেল করব। আইডিয়া কেমন? আর নীলার ওপর এখন মানসিকভাবেও খানিকটা চাপ আছে। লং ড্রাইভে গেলে, মনের মধ্যেও খানিকটা প্রশান্তি আসবে?
শাহেদ কিছু বলার আগেই নীলা বলল, “দারুণ আইডিয়া।”
তারপর শাহেদের কানে ফিসফিস করে বলল, “বুঝেছ এখন, এর কেন এত নাম ডাক?”
শাহেদ বোকার মত হাসল।
ড. রহমান বললেন, “তৃতীয় ব্যাক্তির উপস্থিতিতে কানাকানি করতে নেই। যাই হোক, শাহেদ সাহেব ড্রাইভিং করতে পারেন? আমি পেছনের সিটে বসে আপনার স্ত্রীর কেইস হিস্ট্রি শুনি।”
শাহেদ মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, বোধক।
তিনজন গাড়িতে উঠে বসল।
ড. রহমান নীলার সাথে কথা শুরু করলেন। নীলা বাবা মাকে ছেড়ে এসে তার কতটা কষ্ট হয়েছে, তার বর্ণনা দিতে শুরু করল। ড. রহমান তাকে বোঝাতে লাগলেন, স্বামীই সব। সব মেয়েকেই এটা করতে হয়। এখন তার নতুন পৃথিবী। তার সাথে মানিয়ে নিতে হবে। এবং সেই সাথে শাহেদকে হালকা ডিরেকশন দিতে লাগলেন।
যেতে যেতে হাইওয়ে ছেড়ে তারা একটা গলিতে ঢুকল। রাস্তা দু'দিকে বেকে গেছে। ড. রহমান কিছু বললেন না। শাহেদ নিজে থেকেই ডান দিকে বাক নিল। নীলা অবাক হল। ড. রহমানের মুখে হাসি ফুঁটে উঠল।
খানিকক্ষণ চলার পর ড. রহমান একটা বাড়ির সামনে গাড়িটাকে থামাতে বললেন।
শাহেদ জিজ্ঞেস করল, “এখানে থামাচ্ছেন কেন?”
ড. রহমান শান্ত গলায় বললেন, “চল যেতে যেতে বলছি।”
তারা দোতলা বাড়িটার সিড়ি ধরে ওপরে উঠতে শুরু করল। ড. রহমান বললেন, “আজ এখানে ছাদে আমরা চন্দ্রস্নান করব।” শাহেদ জিজ্ঞাসু চোখে তার দিকে তাকাল। কিছু বলল না।
ছাদে উঠে আবার ড. রহমানই বললেন, “মাই বয়, ড্রিংক করার অভ্যাস আছে?”
শাহেদ কিছু বলল না। আমতা আমতা করতে শুরু করল।
-ও আচ্ছা! বুঝেছি। নববধূর সামনে লজ্জা পাচ্ছ। লজ্জার কিছু নেই। অভ্যাস যেহেতু আছে, আজ হোক কাল হোক শুরু হবেই। আজই না হয় হোক। চল। চিলেকোঠায় ভদকা রাখা আছে।
শাহেদ একবার নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকল। এলোমেলো একটা ঘর। ঘরের এক কোণায় কিছু আঁকাআকির সরঞ্জাম পড়ে আছে। তার এক পাশে একটা টেবিলে ভদকার বোতল, গ্লাস আর বরফ রেখে দেয়া।
শাহেদের কোথায় যেন একটা খটকা লাগল। কিন্তু কিছু বলল না। গিয়ে বসল। নীলা বলল, “তোমরা ভদকা খাও। আমি বরং বাইরে গিয়ে বাতাস খাই।”
ড. রহমান হেসে উঠলেন। শাহেদের মনে হল, কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই ব্যঙ্গার্থে বলেছে। উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল। বিয়ের ষষ্ঠ দিনে যদি স্ত্রীর সামনে স্বামী ভদকার আয়োজন করে, কোন স্ত্রীই সেটা পছন্দ করবে না।
ড. রহমান শাহেদের গ্লাসে ঢেলে দিতে দিতে বললেন, “তোমার লিমিট কয় পেগ?”
শাহেদ বলল, “বারো।” একটু থেমে আবার বলল, “ডক্টর, আমি আপনার কাছে আমার স্ত্রীর সমস্যা নিয়ে এসেছিলাম।”
-তাকে দেখে কি তোমার আগের থেকে ভাল মনে হয় নি?
শাহেদ কিছু বলল না। অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ল।
ড. রহমান আবার বললেন, “এই ভদকার নাটকটাও তার জন্যেই করা। তাকে এটুকু বোঝাতে যে, তুমি তার থেকে কিছু লুকাও না।”
শাহেদ আবার অনিশ্চিতভাবে মাথা নেড়ে গ্লাসে চুমুক দিল।
ত্রয়োদশ পেগ ঢেলে ড. রহমান বললেন, “আমি একটু আসছি।”
বাইরে বেরিয়ে নীলাকে বললেন, ঠিক লৌকিকের মত করে দরজায় শব্দ করতে। নীলা ধীর পায়ে এগিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজায় শব্দ করল।
শাহেদ উঠল না। এই পেগটা শেষ করে, গ্লাসটা টেবিলের ওপর রাখল সশব্দে। কণ্ঠনালী দিয়ে ঝাঝাল একটা স্রোত নিচে নেমে গেল। প্রায় সাথে সাথে মেরুদণ্ড বেয়ে একটা তীব্র অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌছে গেল। মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে প্রচণ্ড জোরে ভাপ বের হয়ে, করোটিতে সজোরে আঘাত করছে। একটু পর সেই দপদপানি কমে গিয়ে, তার চেতনায় বিচ্ছিন্নতা ভর করতে শুরু করল। লৌকিক প্রায় নিঃশব্দে বলল, “ধরেছে।”
(৮)
শাহেদ তুলি ধরেছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ক্যানভাসে একের পর এক আঁচড় পড়ছে। সাদা ক্যানভাস ভেদ করে একটু একটু করে ফুঁটে উঠতে শুরু করেছে এক রমনী।
(৯)
শাহেদ বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।
পাশেই রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ড. রহমান আর নীলা দাড়িয়ে আছে।
ড. রহমান বলতে শুরু করলেন, “রক্ষণশীল পরিবার থেকে শাহেদ যখন প্রথম ঢাকায় আসে, শহরের সাথে সে ঠিক মত মিশতে পারে নি। সুতরাং, বন্ধু বান্ধবহীন এই অলস শহরে সে সময় কাঁটাতে একটা কাজই করত, সেটা হচ্ছে ছবি আঁকা। পাশাপাশি হালকা ড্রিংক করার অভ্যাসও তৈরি হয়ে গেল। দু'টো পাশাপাশি ভাল মতই চলছিল। ভার্সিটির স্বাধীন জীবনে তার কোন সমস্যা হয় নি।
কিন্তু, যখন সে চাকরীতে ঢুকল, তখন তার জন্য এটা একটা সমস্যা হয়ে দাড়াতে শুরু করল। তখন সে আর ছবি আঁকার সময় পেত না। কিন্তু, ছবি আঁকাটা ততদিনে তার অস্থি মজ্জায় ঢুকে গেছে। এটা থেকে তার নিস্তার ছিল না। তাই তার মাঝে আলাদা একটা স্বত্ত্বার জন্ম নিল। শাহেদ তার নাম দিল লৌকিক। আমরা এটাকে বলি Dual Personality বা দ্বৈত স্বত্ত্বা। অর্থাৎ একজন মানুষের মধ্যেই দু'টি আলাদা স্বত্ত্বার বসবাস। দু'জন একই সাথে তার মাঝে থাকে। কিন্তু, একেক সময় একেক জন প্রভাব বিস্তার করে। অন্যজন ঘুমিয়ে থাকে। একজন ন'টা-পাঁচটা অফিস করা সুবোধ ছেলে শাহেদ। অন্যজন লৌকিক। শুক্রবার অফিস বন্ধ থাকায় যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। অর্থাৎ, শুক্রবারে শাহেদের ওপর লৌকিক প্রভাব বিস্তার করত। আর অন্যান্য দিন লৌকিক ঘুমিয়ে থাকত।”
নীলা বলল, “তাহলে গত শুক্রবার আমাদের বিয়ের দিন লৌকিক প্রভাব বিস্তার করতে পারল না কেন?”
ড. রহমান বললেন, “লৌকিকের প্রভাব বিস্তার করার প্রধান সহায়ক ছিল, ভদকাই। লিমিট পার হয়ে গেলে, যখন শাহেদের নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ থাকত না, তখন দেহের নিয়ন্ত্রন নিত লৌকিক। আর সে সময়ই তোমার সাথে তার দেখা হত। কিন্তু, সেদিন প্রথমত সে ভদকা পায় নি। দ্বিতীয়ত, তার ব্যস্ত থাকার মত বহু কাজ ছিল। তাই লৌকিক জেগে উঠতে পারে নি।”
একটু থেমে তিনি আবার বললেন, “আর কোন প্রশ্ন?”
নীলা নীরবে মাথা নাড়ল।
(১০)
একটা ছোট্ট ছিমছাম বাসা। শাহেদ অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছে। ফিরেই হাত-পা চেয়ারে এলিয়ে দিয়েছে। নীলা গাড় লিকারে এক কাপ চা করে নিয়ে শাহেদের সামনে দাড়াল। শাহেদ চা নেয়ার ভান করে নীলার হাত ধরে টান দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। নীলা লজ্জা পেয়ে হাত ছাড়িয়ে নিল।
আড়ষ্ট গলায় বলল, “আচ্ছা, তুমি আমার একটা ছবি এঁকে দিতে পারবে? অয়েল পেইট?”
শাহেদ হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, “কী যে বল না তুমি! ছোট বেলায় খাতায় পেন্সিল দিয়ে ঘষাঘষি করতাম। আমার আঁকাআকি ওই পর্যন্তই। আর আমি আঁকব মানুষের ছবি? তাও অয়েল পেইন্ট!”
শাহেদ ঘর কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।
Comments
Post a Comment