ফেলানী, ভারতীয় পণ্য বর্জন, কিন্তু কেন?

ফেলানী হত্যার প্রহসনমূলক রায়ের পর আমাদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণায় অনেক সুশীলের মাঝেই তীব্র চুলকানি দেখা গেছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের সাথে রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-সুনীল এর সাহিত্য বর্জনের কথা বলে ত্যানা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যারা রীতিমতো মমি তৈরি করে ফেলেছেন, তাদের কাছে বিষয়টি পরিষ্কার করি। আর যারা ফেলানী হত্যার সাথে ভারতীয় পণ্য বর্জনের সংযোগ খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছেন, তাদের জন্যেও তাদের হয়ে আমি সংযোটা খুঁজে দিচ্ছি।
সাহিত্য একটি সার্বজনীন বিষয়। একে কখনই দেশ-কাল-সীমানার গণ্ডি দিয়ে আটকে রাখা যায় না। যায় না বলেই, জোড়াসাঁকোর রবিঠাকুর লেখেন বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত। চুরুলিয়ার দুখু মিয়া হন বাংলাদেশ এর জাতীয় কবি নজরুল। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আমরা খুঁজি বাংলার সৌন্দর্য। পশ্চিমবঙ্গের কিংবা বাংলাদেশ এর নয়। আমরা যেমন আমাদের সবচেয়ে বড় অহংকারকে খুঁজি হুমায়ুন আহমেদের "জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প" এ ঠিক তেমনি আমাদের শেকড়কে খুঁজি সুনীলের "পূর্ব-পশ্চিম" এ। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সাহিত্য গড়ে উঠেছে এদের নিয়েই। এরা আমাদের সাহিত্যের ও অংশ। কখনই তার ওপর আঘাত নন।

কিন্তু ভারতীয় পণ্য অবশ্যই আমাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। আমাদের অর্থনীতি আর সংস্কৃতির ওপর আঘাত করছে, তাদের চলচ্চিত্র, গান, সিরিয়াল, মোবাইল, কিংবা মোটর সাইকেল। এই সবকিছু দিয়ে ভারত আমাদের দেশে রমরমা ব্যাবসা করছে। আর সেই টাকায় বুলেট কেনা হচ্ছে BSF এর জন্য। সেই বুলেট বিঁধছে ফেলানীদের বুকে। সম্প্রতি আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানী শুরু করেছি। আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা এমনিতেই করুণ। সাম্প্রতিক সময়ে যখন তা খানিকটা মাথা তুলে দাড়াতে শুরু করেছিল, তখন এই ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানী তার সমূলে কুঠারাঘাত করেছে। তাদের সিরিয়ালগুলোর কথা না হয় নাই বললাম। প্রতিদিন আধ ডজন সিরিয়াল না দেখলে আমাদের অনেকের পেটের ভাত হজম হয় না। কিন্তু, আমাদের নাটকের মান কী খারাপ? তা যে নয়, তার প্রমান ঈদের সময় আমাদের দেশীয় নাটকের প্রতি আগ্রহ। কিন্তু, বছরের বাকিটা সময়? তা কি দাড়াতে পারে ভারতীয় সিরিয়ালের সামনে? আর এর মধ্য দিয়ে আমরা পঙ্গু হচ্ছি সংস্কৃতির দিক দিয়ে। এবং পঙ্গু হচ্ছি অর্থনৈতিকভাবে।
আপনাদের কি মনে হয় BGB এর সদস্যদের দেশের প্রতি মমত্ববোধ নেই? যখন তারা কোন স্বজাতির লাশ দেখে তখন তাদের ইচ্ছে করে না, সবকিছু ছিঁড়েখুড়ে ফেলতে? ইচ্ছে করে। সেটা তারা দেখিয়েছিল ২০০১ এর ১৮ই এপ্রিল কুড়িগ্রাম এর রৌমারি সীমান্তে ১৮ জন ভারতীয় সৈন্যকে হত্যা করে। ভারতকে পিছু হঁটিয়ে। কিন্তু, সব সময়েই তা সম্ভব হয় না। তারপরই তাদের দাড়াতে হয় তীব্র বাস্তবতার মুখোমুখি। সেদিন যদি ভারত পাল্টা হামলা চালাত তাহলে আমাদের সামরিক বাহিনীর কি সামর্থ ছিল তা ঠেকানোর? ছিল না। নেই আজও। হয়তো নিজেদের ভাবমূর্তি আর আন্তর্জাতিক বিধি নিষেধের কারণে ভারত সেদিন হামলা করে নি বাংলাদেশে। কিন্তু, যদি করত তাহলে তা ঠেকাতে পারতাম না আমরা। কেন পারতাম না? দায়ী আপনার চেন্নাই এক্সপ্রেস, দায়ী রাশি, দায়ী ফেয়ার এন্ড লাভলি, দায়ী হিরো হোন্ডা। এর সবই আমাদের অর্থনীতি কে পঙ্গু করে রেখেছে। পঙ্গু করে রেখেছেন আপনি নিজে।
অনলাইনে যতই চিৎকার করি না কেন, আমাদের অর্থনীতি আর সামরিক বাহিনীকে সুসংহত করতে না পারলে এই "গণহত্যা" বন্ধ হবে না। ভারত-চীন কিংবা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে এত রক্তপাত না হওয়ার কারণ তাদের উন্নত সামরিক বাহিনী। তারা ইটের জবাবে পাটকেল ছোড়ার সামর্থ্য রাখে। যেদিন আমরা চীন বা পাকিস্তানের মত সমানতালে ভারতের সাথে যুদ্ধ করার সক্ষমতা অর্জন করব, সেদিন আমাদের আর কোন ফেলানীর হাহাকার শুনতে হবে না। তার জন্য সবার আগে সুসংহত করতে হবে আমাদের অর্থনীতিকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ার পরও জাপান এত কম সময় এত দ্রুত কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল এবং বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি(বর্তমানে তৃতীয়) হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করল তার কারণ জানতে চান? তাদের উন্নতির এক এবং একমাত্র কারণ হচ্ছে, নিজেদের জাতীয়তার প্রতি তাদের প্রবল অহংকার। প্রবল জাত্যভিমান তাদের রক্তে মিশে আছে।
এই প্রবল জাত্যভিমানের ভেলায় চড়েই বারবার শোষিত হয়েও পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির কাতারে উঠে এসেছে চীন। জাপানের মতই তারা নিজেদের পণ্য ভিন্ন কিছু ব্যবহার করে না। নিজেদের ভাবে পৃথিবীতে অদ্বিতীয় এবং সেই বিশ্বাসকে তারা সত্যি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরেক পরাজিত শক্তি জার্মানির ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। হিটলার যতই নৃশংস হোক না কেন, এ কথা যে কেউ স্বীকার করবে তার দেশপ্রেমে কোন খাদ ছিল না। আর তাই বিশ্বযুদ্ধের পর এত বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়েও জার্মানি আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। ফরাসী বিপ্লবের পর মুখ থুবড়ে পড়া ফ্রান্সকে নেপোলিয়ন আবার সগৌরবে মাথা উঁচু করাতে পেরেছিলেন এই জাত্যভিমানের কল্যাণেই।
তারা যদি পারে তবে আমরা পারব না কেন? হ্যাঁ, আমরাও পারি। আমরাও পারি, আমাদের দেশটাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে। তাকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করতে। সামরিকভাবে শক্তিশালী করতে। তাহলেই আমাদের আর শুনতে হবে না কোন ফেলানীর কান্না।
ভারতীয় পণ্য বর্জনই সেই স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রথম ধাপ।

ইস্টিশন ব্লগ: http://istishon.com/node/4628

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক