অবশেষে শূন্যতা

======================================================
মোবাইলটা অনবরত বেজে যাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। রিসিভ করছি না। ঠিক করে বলতে হলে, রিসিভ করার সাহস পাচ্ছি না। কে কল করেছে, খুব ভাল করেই জানি; প্রিয়তা। আজকে সে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চায়। সে কি জানে না, এটা আমার জীবনে সবথেকে সহজভাবে নেয়া সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত!
======================================================

দিনক্ষণ আমার খুব ভাল মনে থাকে না। একবার একটা টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাঙালি বাঙালিয়ানা ভুলে যাচ্ছে’ টপিকে একটা রিপোর্ট করেছিল। আমাকে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘আজকে বাংলা কত তারিখ জানেন?’
বললাম, ‘জানি না।’
রিপোর্টারের মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
আমি সাথে যোগ করলাম, ‘আমি কিন্তু আজকের ইংরেজি তারিখটাও জানি না।’
টুপ করে তার মুখে চন্দ্রগ্রহন নেমে আসল।

যাই হোক, ওটা জীবনের একটা মজার এবং বিশেষত্বপূর্ণ দিন ছিল। ওটার তারিখ মনে রাখার আমি কোন প্রয়োজন বোধ করি নি। আর কবে কোন দিন আমি কুমের ওপর ব্রিজে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলাম, সেটা মনে রাখার কোন প্রশ্নই আসে না। যে সকল পাঠক কুম শব্দটার অর্থ জানেন না তাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে, এটার অর্থ আমি নিজেও জানি না। তবে, এটা খালের সমগোত্রীয় একটা বস্তু।
ডিসেম্বর মাস। বেশ শীত। আমি ঘন কুয়াশার মধ্যে স্রেফ একটা ফুলহাতা শার্ট গায়ে দিয়ে বসে আছি। এটা আমার নতুন পাগলামী। ইদানীং প্রায়ই করছি। অবশ্য যেহেতু নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করছি, সুতরাং এটা ধরে নেয়া যেতেই পারে, আমি পাগল নই। কারণ, একজন পাগল কখনও নিজেকে পাগল বলে স্বীকার করে না। তবে পরিবার এবং একই সাথে সকল আত্মীয়-স্বজনের দৃঢ বিশ্বাস আমার মাথাটা পুরোপুরি গেছে। চাপে পড়ে আমি নিজেও সেটা বিশ্বাস করার পথে আছে। তবে আর সব পাগলের মত আমার কাজেরও একটা ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। সেটা হচ্ছে, ‘আমি শীতটাকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।’ অবশ্য পাগলের প্রলাপ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এটা নিয়েও ঘামায় নি। প্রথম প্রথম আব্বু দু’চারটা ধমক দিয়েছে। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।

আমি এখন নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। কুয়াশার রণকৌশলটা খুব মজার। সে এমন ঘনত্বে আছে যে, নিচে অস্পষ্ট হতে হতে ঠিক কুমের পানিতে দৃষ্টিসীমা পৌছানোর আগমুহূর্তে কুয়াশা সব আলো দখল করে বসে আছে। মোটামুটি আমার সাথে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। আমি বিনা যুদ্ধে তার সাথে পরাজয় মেনে নিয়েছি। জলের বদলে আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে কুয়াশা দেখছি।

হঠাৎ বৈঠার শব্দ শুনতে পেলাম। পেছন দিক থেকে আসছে। মনে মনে হাসলাম। কোন হতদরিদ্র কিংবা লাগামছাড়া ধনী আসছে। এই দুই শ্রেণি ছাড়া বাকি সবাই ই এখন আসা যাওয়া করে ট্রলারে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট যানগুলোর একটা। এই কুয়াশার মধ্যে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে খারাপ লাগছে না। এই তীব্র নৈশব্দের মধ্যে যদি হঠাৎ কোন ট্রলারের ভটভট আওয়াজ শুনতাম, আমি নিশ্চিত, আমার ইচ্ছে হত ইট দিয়ে নিজের মাথায় একটা বাড়ি মারি।

======================================================
‘ধরব না, ধরব না’ ভেবেও কলটা রিসিভ করে ফেললাম।
ওপাশ থেকে ঝাঝালো গলায় শোনা গেল, ‘তুমি ঠিক এই মুহূর্তে আমার বাসায় আসবা।’
‘পকেটে টাকা নেই ভাড়া দেব কোত্থেকে?’ নিস্পৃহ গলায় একটা খোড়া যুক্তি দাড় করালাম।
‘কেন? তোমার না এত হণ্ঠন রোগ! হাঁটতে হাঁটতে চলে এস। দিনের মধ্যে দশবার হেঁটে শাহবাগ আসা যাওয়া করতে পারলে একবার বনানী আসতে পারবে না?’
‘শাহবাগ এখান থেকে চার কিলোমিটার। তোমার বাসা আট।’
‘I wanna here no more excuse. Can you understand?’
‘I Cant.’
======================================================

নৌকা চালাচ্ছে আক্কাস আলী। আলী পদবীটা আমার নিজের যোগ করা। তার বয়সী একটা লোককে আক্কাস বলে ডাকতে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। তাই, আমি সাথে আলী যোগ করে নিয়েছি নিজ দায়িত্ব। তার আসল নাম শুধুই আক্কাস। আগে পিছে কিছু নেই।

এখন অবশ্য তার পিছনে কিছু আছে। নৌকার একেবারের শেষে একগাদা শাপলা নিয়ে আছে তার ছেলে গনি। আর আছে দু’টো মেয়ে। ক্যাটক্যাটে কালো জিন্স আর একজনের Eminem অন্যজনের Enrique এর ছবি আঁকা টি-শার্ট দেখে তাদের পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়। সম্ভবত তাদের পোষাক কিংবা মাত্রাতিরিক্ত রূপের কারণা আক্কাস আলীর মত বয়োঃবৃদ্ধও বারবার পেছনে তাকাচ্ছেন। আর আমি সদ্য আঠেরো পেরুনো যুবক তো কোন ছাড়।

জাফর ইকবাল কোন মেয়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রায়ই বলেন, ‘মেয়েদের বয়স চট করে ধরে ফেলা যায় না।’ সম্ভবত তার নিজের এই দুর্বলতা ছিল বলে, এমন কথা বারবার বলেছেন। মানুষ সবাইকে বিচার করে নিজেকে দিয়ে। তাই ভেবেছেন সবার এই সমস্যা আছে। তবে, মজার ব্যাপার হচ্ছে, অন্যদের কথা জানলেও এই সমস্যাটা আমারও ঠিকই আছে। আমিও চট করে কারও বয়স ধরতে পারি না। তবে নিচে যে দু’জনকে দেখা যাচ্ছে তাদের একজন সম্ভবত ভার্সিটির সেকেন্ড বা থার্ড ইয়ারে পড়েন। এবং অন্যজন এবছর কিংবা গত বছর SSC দিয়েছে। অনুমান নির্ভুলই হবার কথা। সম্ভবত তারা বোন।

আমি ওপর থেকে হাক দিলাম, ‘কি রে গনি! কই যাস?’ নৌকার চারযাত্রী উৎসুক হয়ে ওপরে আমার দিকে তাকাল।
গনি উত্তর দেবার আগেই আক্কাস আলী বিরক্ত গলায় উত্তর দিল, ‘জানি না।’
বুঝলাম বড়লোকের শখ হয়েছে নৌকায় ঘোরার। তাই ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া করেছে।

হঠাৎ দেখলাম আক্কাস আলী দ্রুত নৌকা পাড়ে ভেড়াচ্ছে। হয়তো সময় শেষ। কিংবা এখন পাকা রাস্তা ধরে মেয়ে দু’টো কোথাও যাবে।

ঘাটে ভেড়াতেই ছোট মেয়েটা তাদের গলায় ঝোলানো DSLR এ আমার একটা ছবি তুলল। তোলার কারণটা চিন্তা করার ইচ্ছে হল না। তার চেয়ে কী প্রতিক্রিয়া দেখাব, তাই ভাবলাম। ঢাকা হলে নির্ঘাত অনুমতি না নিয়ে ছবি তোলার জন্য একটা হইচই বাধিয়ে দিতাম। কিন্তু, গ্রামের একটা ছেলের ছবি কেউ তুললে সে ভাল করে পোজ দেবে পরের ছবিটার জন্য। আমি কোনটাই করলাম না। যেভাবে বসে ছিলাম সেভাবেই থাকলাম।

মেয়েটা দ্রুত পায়ে কুমের পাড় বেয়ে ওপরে উঠল। পাকা রাস্তার ঢাল বেয়ে ওঠার সময় প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। কোন মতে সামলে নিল। পেছনে তার ‘সম্ভবত বড় বোন’ ধীরে ধীরে আসছে। তার চোখে রাজ্যের বিরক্তি।

মেয়েটা আমার কাছে এসে বলল, ‘এভাবে বসে আছ, তোমার ভয় করছে না?’
ভ্রু কুঁচকালাম। আপনি সম্বোধন আশা করেছিলাম। তবে, এ বোধ হয় কাউকে আপনি বলে অভ্যস্ত না।বললাম, ‘ভয়ের কী আছে?’
‘যদি পড়ে যাও?’

হাসলাম। মেয়েটাকে খানিকটা চমকে দিতে ইচ্ছে হল। তাই ব্রিজের ওপর থেকে কুমে একটা লাফ দিলাম। ফল হল চমৎকার। মেয়েটা ভয়ে প্রকাণ্ড একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। মনে হল সে ধরে নিয়েছে, আমি নির্ঘাত মারা গেছি। তার ‘সম্ভবত বড় বোন’ তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেখাতে চাইছে আমি মরি নি। বেঁচে আছি বহাল তবিয়তে। সে চিৎকার করছে, ‘ফুপি, ছেলেটা মরে গেছে।’ বুঝলাম, অনুমান ভুল ছিল। মেয়েটার ‘সম্ভবত বড় বোন’ তার ‘নিশ্চিত ফুপি।’ তার ‘নিশ্চিত ফুপি’ যখন অতিকষ্টে তার মুখের সামনে থেকে তার দু’হাত সরাল তখন সে রীতিমত বিস্ময়ের সাথে দেখতে পেল, ‘আমি মারা যাই নি এবং সুস্থ স্বাভাবিক দেহে কুমে সাতার কাটছি।’

প্রিয়তার সাথে প্রথম পরিচয়টা এভাবেই।

======================================================
হাটছি গত দেড় ঘণ্টা ধরে। সাধারণত এত আস্তে আস্তে আমি হাঁটি না। আজকে হাঁটছি, কারণ মস্তিষ্ককে যথেষ্ট সময় দেয়ার চেষ্টা করছি। প্রিয়তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? অনুমান করতে পারছি না। আমার অনুমান শক্তি খুব উন্নতমানের নয়। এই পরিস্থিতিতে সেটা কাজ করবে আরও খারাপ। শুধু শুধু মস্তিষ্ককে চাপ দিয়ে লাভ নেই।
======================================================

এই ছোট্ট একটা অপ্রয়জনীয় দেখায় আমাদের পরিচয়টা এতদুর কিভাবে গড়াল সেটা আজও অবাক হয়ে যাই। বিশেষত, ছেলেটা যখন আমি। কারও সাথে কথা বলার সময় সে দশটা বললে আমার মুখ দিয়ে একটা কথা বেরোয় কিনা সন্দেহ! সেই আমি কিভাবে তার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যেতাম জানি না। মোবাইলে কথা বলা ছিল আমার কাছে প্রচণ্ড বিরক্তিকর একটা বিষয়। সেই আমার কান থেকে চার্জ শেষ হবার আগ পর্যন্ত মোবাইল নামত না। সব থেকে বড় বিষয় হচ্ছে আমি ভালবাসায় বিশ্বাস করতাম না। সেটা এখনও করি না। তবু এটা খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারি আমার মধ্যে নতুন একটা অনুভুতির জন্ম হয়েছে তার নাম আমার ঠিক জানা নেই। তার আদৌ কোন নাম আছে কিনা ভাল করে জানা নেই সেটাও। তবু জানি, আমার মাঝে নতুন কিছু সৃষ্টি হয়েছে। নতুন কেউ সৃষ্টি হয়েছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার মাঝের এই নতুনত্বকে মেনে নিতে আমি রাজি ছিলাম না কখনই। আমি সব সময়েই ব্যাস্ত ছিলাম নিজেকে নিয়ে। নিজের মাঝের জগতটাকে নিয়ে। তাকে ছেড়ে কোনও নতুনত্বকে মেনে নিতে যতটুকু উদারপন্থি হতে হতে হয় তা আমি ছিলাম না কখনই। আজও তা হয়ে উঠতে পারি নি।

কিন্তু, প্রিয়তা ঠিকই আমার জীবিনে নতুন কিছু হয়ে এসেছিল। ও যে আমাকে অন্ধের মত ভালবাসে সেটা না বোঝার মত কোন বিষয় নয়। ও ওর পুরোটা জীবন দিয়ে দিতে পারে স্রেফ আমার মুখ থেকে একটা শব্দ শোনার জন্য, 'ভালবাসি।'

======================================================
প্রিয়তাদের সুবিশাল এপার্টমেন্টের সামনে দাড়িয়ে আছি। দারোয়ান বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। আমার এখানে আসাটা যে সে পছন্দ করে না, সেটা আমি জানি খুব ভালভাবেই। কিন্তু, তাকে কে বোঝাবে আমার এখানে আসাটা তার চেয়ে বেশি অপছন্দ করি আমি।
======================================================

মন থেকে এই সম্পর্কটাকে আমি মেনে নিতে পার নি কোনদিনই। আমার প্রথম আপত্তিটা ছিল, অর্থনৈতিক দুরত্বে। আমি নেহায়েত নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। মাসের শুরুতে বাবা যে বেতনটা পায় সেটা মাসের শেষের মত এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি ফিতে চায় না। তার ওপর পাথরের মত চেপে বসে থাকে মধ্যবিত্ত আত্মসম্মান।

দুজনের মানসিকতার দুরত্বও নেহাত কম না। ছোটবেলা থেকেই তীব্র বাস্তবতার মুখোমুখি দাড়িয়ে বড় হওয়ায় আমি গড়ে উঠেছিলাম সেভাবেই। রসবোধ আমার মাঝে খুব প্রবল ছিল না। যেটা প্রবল ছিল সেটা হচ্ছে তীক্ষ্ণ বাস্তববোধ।

প্রিয়তা ছিল ঠিক তার উল্টো। বাস্তবতা নামে যে একটা শব্দ আছে, সেটাই হয়তো ওর জানা ছিলো না। থাকার কথাও নয়। প্রথমতই, ওর মত ধনীর দুলালীদের কখনও বাস্তবতার নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি দাড়াতে হয় না। সেটা যদি প্রিয়তার মত বাবা মায়ের আদরের একমাত্র মেয়ে হয় তবে তো আরও নয়।

সরলতা যেখানে বোকামি হিসেবে গন্য হতে শুরু করে, প্রিয়তার মানসিকতার বাস ঠিক সেখানটায়। ওর মাঝে বাস করে লাগামছাড়া সরলতা। আর আমি ঠিক তার বিপরীত।

দু'জনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আরও কাজ করে থাকতে পারে আমার লাগামছাড়া শ্রেণিবিদ্বেষ। আজকাল এই লাগামছাড়া বড়লোকগুলোকে দেখলে আমার কেন যেন বড্ড বেশি করুণা হয়। ভাগ্য নিজের হাতে নিয়ে তাদের জন্ম। জীবন সেখানে অথর্ব। জীবনকে যাপন করি আমরা। মধ্যবিত্তরা। নিম্নবিত্তের হারানোর কিছুই থাকে না। তাই তারা ঝুকি নিতে ভয় পায় না। আর উচ্চবিত্তের হারালেও রয়ে যায় তার চেয়ে বেশি। কিন্তু, প্রতি পদে শঙ্কা আর ভয় ঘিরে থাকে মধ্যবিত্তদের। ‘এ টুকু হারালেই তুমি শেষ’ - জীবনের বাস্তব অ্যাডভেঞ্চার।

তাছাড়া উচ্চবিত্তের মানসিকতার প্রতি আমার অশ্রদ্ধা প্রবল। ভালবাসার ওপর আমার বিশ্বাস নেই বললেই চলে। আর সেখানে যখন উচ্চবিত্ত নামক শব্দটার অনুপ্রবেশ ঘটে তখন সেই বিশ্বাস শূণ্যেরও নিচে নেমে যায়। কেবল মনে হয় ওদের আবেগের জন্য একটা শব্দই যথার্থ, ‘সাময়িক।’

আর সবথেকে বড় কথা হল, কৈশোরের আবেগটাই এমন। কোন ছেলের মাঝে সামান্য কিছু বৈচিত্র দেখলেই, তাকে ভাল লাগতে শুরু করে। কৈশোরটা মিলিয়ে যাবার সাথে সাথেই সেই ভাল লাগটুকুও মিলিয়ে যেতে সময় নেয় না। অবশ্য, যতদিন না সেই আবেগ মিলিয়ে যায়, ততদিন তার গভীরতা হয় অতলান্তিকের মতই।

যদিও মাত্রাতিরিক্ত আবেগ ছাড়া প্রিয়তার সাথে এর বেশির ভাগই মিলত না, তবুও আমার জীবনবোধকে আমি এক লহমায় বিতাড়িত করতে পারি নি।

======================================================
‘এইখানে দাড়ায় আছেন ক্যান? ভেতরে গেলে ভেতরে যান।’ দারোয়ান বিরক্ত গলায় বলল।
-ভেতরে আছে কে কে?
-খালি আফামনি।

হতাশ চোখে সামনে পা বাড়ালাম।
======================================================

প্রিয়তা বেতের চেয়ারটায় বসে আছে। তার সামনে আর একটা বেতের চেয়ার রাখা। চেয়ারের ওপর খানিকটা পানি ফেলে রাখা। ইচ্ছে করেই ফেলে রাখা। যেন আমি অসতর্ক হয়ে সেখানে বসে পড়ি। আজ পর্যন্ত কোনদিন প্রিয়তার এই কাজটা করতে ভুল হয় নি। আমারও কোনদিন ভুল করে সেখানে বসে পড়তে ভুল হয় নি।

আজ হল। এর মানে দাড় করানো যায়, আজকের দিনটা আর সব দিনের মত করে যাবে না। আজকে অন্য কিছু ঘটবে। কিংবা আজকে অন্য কিছু ঘটেছে।

চেয়ারটায় বসলাম। বললাম, ‘কেমন আছ?’

প্রিয়তা কোন উত্তর দিল না। অবশ্য কোন উত্তর আশা করিও নি। মেয়েটা বড্ড বেশি অভিমানী। এত অভিমানী হলে চলে?

দু’হাত দিয়ে প্রিয়তার মুখটা ধরলাম। অসম্ভব ঠাণ্ডা। বরফ শীতল। বললাম, ‘Can you forgive me?’
মনে হল প্রিয়তা উত্তর দিল, ‘I cant’.

কিন্তু জানি, প্রিয়তা কোন উত্তর দেয় নি। কখনও দেবেও না। মেয়েটা এত অভিমানী কেন? না হয় আমার সাড়া দিতে খানিকটা দেরিই হল। তাই বলে ওকে অসাড় হয়ে যেতে হবে? একটু দেরি করেছি বলেই মিলিয়ে যেতে হবে নিঃসীম শূন্যতায়?

নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম। হঠাৎ মনে হল, চোখের কোণায় এক ফোঁটা জল চিকচিক করে উঠল। অবাক হলাম। মধ্যবিত্তের কান্না! এর মত বিস্ময়কর আর কী আছে? মধ্যবিত্তের বাস্তবতার মাঝে আবেগের ঠাই পাওয়াই তো দুষ্কর।

======================================================
======================================================
======================================================

বাবা বেশ কিছুদিন ধরেই জামিনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করছেন। পাচ্ছেন না। বেশ ওপর মহল থেকেই নির্দেশ আছে জামিন না দেয়ার। কোন প্রমান না থাকলেও আমার ফাঁসি হয়ে যাবে। সেখানে প্রমান আছে। প্রিয়তার মুখে আমার স্পষ্ট হাতের ছাপ। সুতরাং, আমি তাকে জোর করে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি, এটা প্রমানে অসুবিধার কোন কারণ নেই। প্রিয়তার বাবার নিজের মেয়ের মৃত্যুশোক ভুলতে অন্য কারও মৃত্যু সংবাদ শোনা দরকার। আমি উচ্চবিত্তের খেয়ালের গিনিপিগ। কেউ বিশ্বাস করবে না, আমি ওর মুখটা স্পর্শ করেছিলাম ওকে শেষবার মত অনুভব করার জন্য। ওর প্রাণহীন সরল-পবিত্র মুখটাকে স্রেফ একবারের জন্য দু'হাতে জড়িয়ে ধরেই আমি বেরিয়ে এসেছিলাম, এ কথা বিশ্বাস করবে না কেউ। স্বয়ং আমার বাবাও বোধ হয় বিশ্বাস করেন নি। যদিও প্রিয়তার মৃত্যুর সময় থেকে হিসেব করলেই খুব সুন্দর করে বেরিয়ে আসে, এতক্ষণ কারও মুখে হাতের ছাপ টিকে থাকে না। 

কথাটা বলি নি কাউকে। কারণ, আমার ফাঁসি নিশ্চিত হয়ে আছে। প্রমান পক্ষে থাকলেও হবে। প্রমান বিপক্ষে থাকলেও হবে। বরং আমার এখনকার চিন্তা, জামিন হবে কি’না এটা নিয়ে। একবার জামিন পেলেই আমি পগার পার। আমাকে আর পায় কে? মাঝে মাঝে যখন আমার ফাঁসির দৃশ্যটা কল্পনা করি, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি।

প্রিয়তার স্মৃতিগুলো এখন লীন হয়ে গেছে। সেগুলো অতীত। মধ্যবিত্তের জীবনে অতীত অপ্রয়োজনীয়। তার সৃষ্টিই হয় ধ্বংস হয়ে যাবার জন্য।

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক