অসহায়

     প্রথম বার যখন ওর নিথর দেহটা দেখলাম, বিশ্বাস করতে পারিনি। ওর সাথে আমার কখনও কথা হয়নি। শুধু শুনেছি ওকে নিয়ে। দীপকের কাছে, রাতুলের কাছে, রূপকের কাছে, হিমেলের কাছে… সবথেকে বেশি শুনেছি সোহেল, আমার ছোট ভাইয়ের মুখ থেকেই। কেউ ওকে কোনদিন ভাল বলেনি। তাই ওকে নিয়ে আমার নিজের ধারণাটাও খুব বেশি পরিচ্ছন্ন ছিলনা।

     মেয়েটার নাম শাড়িকা। আমাদের ফ্লাটের সামনের বিল্ডিংটায় থাকত। দেখতে খারাপ ছিল বলা যাবেনা। তবে ওকে কখনও সেভাবে দেখিনি। এলাকায় ভাল ছেলে হিসেবে আমার যেটুকু সুনাম ছিল সেটা টিকিয়ে রাখতেই বোধ হয় এমনটা করেছিলাম। পড়ালেখায় ও খুব ভাল ছিলনা। সেটা আমিও ছিলাম না। কিন্তু, ভদ্র ছেলেদের সবাই সবসময় ভাল ছাত্র হিসেবেই মনে করে। তাই, আমাকেও সবাই ভাল ছাত্র বলেই জানত। ঘর থেকে খুব বেশি বের হতাম না। সারাক্ষণ ফেসবুক, ব্লগিং আর কম্পিউটার গেমস নিয়ে পড়ে থাকতাম। খুব বেশি একঘেয়ে লাগলে বারান্দায় গিয়ে বসতাম। আমাদের দু’জনের বাসাই ছিল নিচতলায়। বারান্দায় গেলেই দেখতে পেতাম, ওর বাসার সামনে ছেলেদের ভিড়। অধিকাংশই আমার সমবয়সী, কিছু বড় আর কিছু ছোট।

     ওর সম্পর্কে ধারনাটা আর একটু খারাপ হত। ঘরে এসে আবার ফেসবুকে লগইন করতাম। এই ভার্চুয়াল পৃথিবীর বাইরের অংশটা নিয়ে আমার ধারনা ছিল খুবই কম।


     ওর মা কখনও সখনও আসত কোন একটা বইয়ের জন্য। কখনও বা সোহেলকে বলত আমি যেন ওর কেমিস্ট্রি প্রাকটিকালটা করে দিই। আমি সতর্কতার সাথে সবকিছু এড়িয়ে যেতাম। হয়ত বুঝত, হয়ত না। সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা কোন কালেই ছিলনা।

     সেদিনও আমি বসে ফিফা টুয়েলভ খেলছি। আমার এস.এস.সি পরীক্ষা তখন চলছে। বাইরে কিসের যেন একটা গোলমাল শুনতে পেলাম। গুরুত্ব দিলাম না। এই ম্যাচটা জিতলেই এফ.এ কাপের চ্যাম্পিয়ন হব। দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলাম যেন শব্দ না আসে।

     সন্ধ্যা সাড়ে ন’টা- রাত তিনটার আগে কখনও ঘুমোতে যাওয়া হয়না, তাই সাড়ে ন’টা আমার কাছে সন্ধ্যাই। পাশের বিল্ডিং থেকে একটা চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। সাধারণত আমি এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাই না। ইচ্ছে হলে পরে আম্মুর থেকে জেনে নিই। সেদিন কেন যেন মনে হল আমার যাওয়া উচিত। মনের অর্থহীন আকাঙ্ক্ষাগুলোকে আমি সব সময়েই একটু বেশি গুরুত্ব দিই। তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। স্রেফ কৌতূহলের বশে। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই খেয়াল করছিলাম না। হঠাৎ, খেয়াল করলাম শাড়িকাদের বিল্ডিংয়ের দারোয়ান একটা বটি হাতে নিয়ে ওদের ফ্লাটে ঢুকছে। প্রথমে মনে হল, বোধ হয় ডাকাত পড়েছে ওদের বাসায়। কিন্তু সমাধানটা গ্রহণযোগ্য মনে হল না। 

     আর কি হতে পারে চিন্তা করছিলাম। হঠাৎ, আম্মু আর্তনাদ করে উঠল, ‘গলায় দড়ি দিল না’কি মেয়েটা?’

     উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হল না। পরক্ষনেই কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে ওর নিস্পন্দ দেহটা বের করে আনল। জ্ঞান ছিল না। সবার কথায় বুঝতে পারলাম এখন ওকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হবে। নিজের অনুভূতিগুলোকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এখনও নড়ে উঠবে ওর চোখের পাতা। প্রথমবারের মত ওর জন্য এক টুকরো মমতা অনুভব করলাম।

     নিঃশব্দে ভেতরে এসে বসলাম। তারপর আম্মুর মুখে সব শুনলাম। শাড়িকা ওর সমবয়সী একটা ছেলেকে ‘ফ্রেন্ডশিপ ডে’তে কার্ড দিয়েছিল। সেটা সেই ছেলের মায়ের হাতে পড়ে। আজকে বিকেলে, সেই ছেলেটার মা এসে শাড়িকার মাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। তারপর শাড়িকার মা শাড়িকাকে ঘরে নিয়ে প্রচণ্ড মারে। অভিমানী মেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। কে জানত তার অভিমান এতটা প্রগাড় ছিল?

     আমি এটুকু শোনার পরে আবার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। যদি আর কিছু জানতে পারি! শাড়িকার আর কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। নিশ্চুপ-ভাবে বারান্দায় বসে রইলাম। খানিক পরে অশোকের মাকে বলতে শুনলাম, ‘এই সবকিছু হইছে, হিন্দি নাটক আর সিনেমা দেইখা। বাপ-মায় একটু শাসন করব না? তার জন্যে গলায় দড়ি দেয়া লাগে?’

     বাইরে থাকতে আর ভাল লাগল না। পড়ার টেবিলে এসে বসলাম। সামনে ফিজিক্স বই খোলা। চোখের সামনে অক্ষরগুলো স্পষ্ট। তবু পড়তে পারছি না। জীবনে প্রথমবারের মত শাড়িকার জন্যে খানিকটা সহমর্মিতা অনুভব করলাম। 

     মনে হল ওর মনটা পরিষ্কার ছিল। তাই সবার সাথে খোলাখুলি-ভাবে মিশেছে, কথা বলেছে। দূষিত ছিল আমাদের মন। তাই সেটাকে খারাপ চোখে দেখেছি। নিজের প্রতি প্রচণ্ড একটা হীনমন্যতার সৃষ্টি হল। বারবার মনে হতে লাগল, যদি শুধু একবারের জন্য ওর সাথে কথা বলার সুযোগ হত! হয়তো বা ওর কষ্টটা কমিয়ে দেয়ার সামর্থ্য আমার ছিল। হয়তো বা ও ওর যন্ত্রণাগুলো আমার সাথে ভাগাভাগি করত। হয়তো বা ওর কষ্টগুলো আমার কাছে প্রকাশ করত। হয়তো বা গ্রহণ করত একজন ভাল বন্ধু হিসেবে। তাহলে হয়তো বা ওর কষ্টগুলো একের পর এক জমা হয়ে হিমালয়ের মত ওকে নিষ্পিষ্ট করতে পারত না। হয়তো ওকে এভাবে তিলে তিলে নিঃশেষ করতে পারত না। এভাবে অগোচরে বিদায়ও নিত না।হঠাৎ, আম্মু রুমে ঢুকল। দরজার আওয়াজের ঘোর কেটে যেতেই বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম। আমার এ ধরণের আচরণর সাথে আম্মু পরিচিত, তাই অবাক হল না। শুধু বলল, মেয়েটার জন্য দোয়া করিস। যেন ভাল হয়ে যায়। 

     আমার কোন উত্তর না পেয়ে আম্মুই আবার বলল, ‘আজ-কালকার ছেলে মেয়েগুলো কি হয়ে গেছে! বাবা-মা কি এদের একটু শাসন করতে পারবে না?’

কথাটা শুনে একরকম ক্ষেপে উঠলাম, ‘সব দোষ শাড়িকার? আর ওর মায়ের কোন দোষ নেই? নিজের মেয়ে কি করতে পারে বা না পারে তার নিয়ে তার কোন ধারণাই নেই? শাড়িকার দোষ থাকতে পারে কিন্তু, তার মা কি একবারও ওকে সামনে বসিয়ে আদরের সাথে বোঝানোর চেষ্টাটুকুও করেছে? আমি লিখে দিতে পারি করেনি। তোমরা কোনদিনও আমাদের মানসিকতাটাকে বোঝার চেষ্টা করনা। তোমরা আমাদের স্বাধীনতা দাও না। কিন্তু, আমাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা কর। মনে কর বাবা-মা হয়েই সব দায়-দায়িত্ব শেষ। একবারও কি আমাদের বন্ধু হয়ে আমাদের সাথে বসে আমাদের অনুভূতিটাকে বোঝার চেষ্টা করেছ? করনি। তোমরা বাবা-মা হয়েছ, বাবা-মা হয়েই থাকতে চাও। কখনও আমাদের বন্ধু হবার চেষ্টা কর না।’

     প্রায় কেঁদে উঠলাম। অতি-কষ্টে কান্না সংবরণ করলাম। তারপর আবার বলতে লাগলাম, তোমরা শুধু বল আমরা অবুঝ। আচ্ছা, আমাদের ভালমন্দ বোঝার কোন সুযোগ কি তোমরা আমাদের একবারও দিয়েছ? সব সময় আমাদের দোষটাই দেখতে পাও। আমাদের অসহায়ত্বটাকে কি একবারও দেখতে পাওনা?’

     আম্মু কোন উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল। এবার আর চোখের পানি লুকিয়ে রাখতে পারলাম না। ডুকরে কেঁদে উঠলাম। শাড়িকার জন্যে নয়, কৈশোরের অসহায়ত্বের জন্য।

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক