স্বপ্ন
(১)
সন্ধ্যে ৬ টা ২০
তনুশ্রী ছাদে দাড়িয়ে আছে। মুখে রাগটা স্পষ্ট। অবশ্য রাগটা যে পুরোটাই কপট সেটা তনুশ্রী নিজে যেমন জানে, ঠিক তেমনি জানে নিচে দাড়িয়ে থাকা সজল। তনুশ্রী মোবাইলে কটমট করে বলল, “এই ভর সন্ধ্যের সময় এসবের মানে কী? একটু পরে বাবা ফিরবে। যদি তোমাকে দেখে ফেলে?”
সজল হাসল। অপরাধ স্বীকার করে নেবার হাসি। রোমান্টিক কোন উত্তর দিতে চাইছে। কিন্তু, মাথায় কিছু আসছে না। জীবনানন্দের কোন কবিতা এলেও হত। আফসোস! তাও আসছে না। হঠাৎ, কিছু না বুঝেই আউড়ে ফেলল, “পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে বনলতা সেন”।
-মানে কী এর?
খানিকক্ষণ সজল কিছু বলার মত খুঁজে পেল না। লাইনটা হঠাৎ কেন বলেছে নিজেও জানে না। কিন্তু, এখন কিছু বলা দরকার। জগাখিচুড়ি পাকিয়ে বলে ফেলল, “দেখছ না, পাখিগুলো নীড়ে ফিরছে। আমিও আমার পাখিটাকে দেখতে এলাম”।
-কাল সারাদিন তো একসাথে থাকবই। না’কি? তখন যত খুশি দেখ। এখন যাও। প্লিজ!
যদিও বলল, কিন্তু তনুশ্রী চাইছে সজল যেন আরও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকে? আরও অনেকক্ষণ? কতক্ষণ? অনন্তকাল? পৃথিবীর ইতিহাসের শেষ দিন পর্যন্ত? ইশ! যদি তাই হতো! তনুশ্রীর চোখের কোণায় এক ফোঁটা অশ্রু জমল। নিজের ওপরও রাগ হল। এই বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে সে এতটা ভালবাসে কেন?
কালকে একসাথে থাকার কথা বলতেই সজলের হঠাৎ মনে পড়ল, সে তনুশ্রীর জন্য একটা শাড়ি এনেছে। লাল পেড়ে সাদাশাড়ি। এই শাড়িটা পরেই কাল তনু যাবে তার সাথে। ফিসফিস করে বলল, ‘তনু’।
-হুম বল।
-তোমার জন্য একটা শাড়ি এনেছি। কাল তুমি এটা পরেই যাবে। কিন্তু, শাড়িটা কি করে দিই বল তো।
তনুশ্রী দশ সেকেন্ড চুপ থাকল। তারপর বলল, আমি আসছি।
(২)
রাত ৮টা
তুর্য পড়ার টেবিলে। মাথায় শুধু ঘুরছে, ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’। মাথায় শুধু ঘুরছে, কালকে কী কী করবে? কালকে ঠিক ৫:৩৭ এ ভোর হবে। ঠিক তখনই সবাইকে এস.এম.এস. করতে হবে “Happy New Year”. ধুর! কালকে বাংলা নববর্ষ। এদিন ইংরেজিতে উইশ করা যায় না’কি? ওর মোবাইলে বাংলাও লেখা যায় না। তুর্যের নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
মাথার ভেতর শুধু ঘুরঘুর করছে, কালকে ঠিক কী কী করবে? সব চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন ঘোরাঘুরি? নাহ! দিনটা সাদামাটা হয়ে যাচ্ছে। ধুর ছাই! কিচ্ছু মাথায় আসছে না। আবার কালকে বেশি এক্সাইটমেন্ট দেখিয়ে ফেলা যাবে না। ওর বন্ধুরা সবাই সব সময় টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। ওদের কাছে এসব সাধারণ। কিন্তু, ও জীবনে প্রথমবারের মত বন্ধুদের সাথে বাইরে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। ওর জন্য অবশ্যই এটা বিশেষদিন। আব্বু যে কীভাবে অনুমতি দিয়ে দিল এখনও অবাক লাগে। দেখা যাবে, এখন কে ওকে ‘ফার্মের ব্রিলিয়ান্ট মুরগি’ বলে ক্ষেপায়! তুর্য’র চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি ওর বইয়ে পড়ল। তুর্য নিজেই বুঝতে পারল না কেন পানিটা পড়ল? ওকে সবাই ‘ফার্মের ব্রিলিয়ান্ট মুরগি’ বলে ক্ষেপায় সেই কষ্টে? না’কি কালকে ও একদিনে অনেকটা বড় হয়ে যাবে সেই আনন্দে? এটা কীসের অশ্রু? কষ্টাশ্রু? না আনন্দাশ্রু?
হঠাৎ, খাবার জন্য মা ডাক দিল।
(৩)
রাত ১০টা
তুহিন যথাসম্ভব শব্দ না করে খাবার চেষ্টা করছে। বাবার মতিগতি সুবিধের ঠেকছে না। কালকে বটমূলে না যাবার অজুহাত খুঁজছে। এখন খাবার সময় শব্দ হলে হয়তো দেখা যাবে, বাবা ঘোষণা দিয়ে বসেছে, ‘যে ছেলে খাবার ভদ্রতা করতে জানে না সে রমনা বটমূলে গেলে আরও বান্দর হয়ে যাবে। সুতরাং, মিশন বটমূল ক্যান্সেল’।
এমনটা হলেও হতে পারে। বাবা কখন কী করেন তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। হঠাৎ, ছোট বোন মাইশা মাছ নিতে গিয়ে প্লেটে বাটিতে ঠোকাঠুকি লাগিয়ে দিল। তুহিন আঁতকে উঠল। মনে হল, ওর হৃদপিণ্ডে কেউ দশ কেজি ওজনের একটা হাতুড়ি দিয়ে ঘা দিয়েছে। রাগে চোখ কটমট করে মাইশার দিকে তাকাল। রাগী মানুষের চোখ থেকে আগুন বের হবার ব্যবস্থা থাকলে,মাইশা এতক্ষণে সেই আগুনে পুড়ে কাবাব হয়ে যেত। ভাগ্যিস নেই।
অবশ্য, মাইশা এতে কোন গুরুত্ব দিল না। যেহেতু, কোন অবস্থাতেই মানুষের চোখ থেকে আগুন বের হয় না, তাই ভাইয়াকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই। তুহিন হাল ছেড়ে দিয়ে বাবার দিকে তাকাল। নাহ! শব্দটা বাবার মনোযোগ আকর্ষণ করে নি। এখনও সেভাবেই খাচ্ছেন। এক মনে কী যেন ভেবে চলেছেন। নিশ্চয় অফিসের কোন কাজ হবে। তুহিন তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বাবার চোখের সামনে থেকে সটকে পড়ার দিকে নজর দিল। খাওয়া শেষ করে ডাইনিং টেবিল থেকে উঠে যখন দরজার কাছে পৌঁছল, তখন পেছন থেকে বাবা ডাক দিলেন। তুহিনের বুকটা ধড়াস করে উঠল। পেছন থেকে বাবা বললেন, ‘তুহিন, এবার লাগাতার হরতালে জন্য অফিসের কাজে অনেক গ্যাপ পড়ে গেছে। তাই অথরিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কালও অফিস খোলা থাকবে।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘আই অ্যাম সরি।’
তুহিন কোন উত্তর দিল না। নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল। তার দু’গাল বেয়ে পানি বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে।
(৪)
রাত ১১টা ৩০
তুলি বিছানায় গুটিয়ে শুয়ে আছে। দেখতে ঠিক বিড়ালের বাচ্চারমত লাগছে। ফাহিমা মুগ্ধ চোখেতার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখতে একেবারে পরীর মত লাগছে। নাহ! পরীও এতটা সুন্দর হবে কি’না ফাহিমার সন্দেহ আছে।
ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে এখন জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে। কিন্তু, সেটা সম্ভব না। তুলির গায়ে এখন একটা ফুলের টোকা লাগলেও সে জেগে যাবে। আর একবার জেগে গেলে তাকে ঘুম পাড়ানোর সাধ্য পৃথিবীর কোন মানুষের নেই। একেবারে ওর বাবার মত হয়েছে। তমালও অনেক রাত পর্যন্ত জাগত। নিজে ঘুমাতো না, ফাহিমাকেও ঘুমাতে দিত না। সারারাত গুটুরগুটুর করে কথা বলত। বিয়ের আগে ভার্সিটির হলে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর ফাহিমা মোবাইলে তমালের সাথে কথা বলত ঠিক তেমনি করে। তখন ফাহিমা চাইত, যত কথা বলার তখনই বলে ফেলতে। কে জানে, বিয়ের পর হয়তো আর ওর কথা শুনতে ভাল লাগবে না। বিয়ের পর তো সবাই কত বদলে যায়। যদি সে নিজেও বদলে যায়! যদি তমালকে আর আগের মত ভাল না লাগে!তমালিকা আপুও তো ভালবেসে বিয়ে করেছিল। তিন বছর পরই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দু’জন দু’জনকে এতটা ভালবাসত। অথচ, বিয়ের পর আর একসাথে থাকা হল না। যদি তাদেরও তেমন কিছু হয়! কথাগুলো ভাবতেও ফাহিমার বুক কাঁপত।
অবশ্য ফাহিমার জীবনে তেমন কিছু ঘটে নি। তবে, কিছু ঘটেছিল অবশ্যই। অনেকটা সে রকমই। ছয় বছর পর। ঠিক একমাস সতের দিন আগে তমালকে তার অফিসের পাশে কেউ জবাই করে রেখে গেছে। তার অপরাধ? সে পত্রিকায় ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লিখত। সে লিখত উগ্রতার বিরুদ্ধে। সে লিখত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। সে লিখত ভালবাসার পক্ষে।
নিজের অজান্তেই ফাহিমার গাল বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু তুলির গায়ে পড়ল। তুলি নড়ে উঠল। কিন্তু, জাগল না। ঘুমের ঘোরেই ফাহিমাকে জড়িয়ে ধরল। পরম মমতায়!
(৫)
পরদিন: ভোর ৬টা ২০
লাল পেড়ে সাদা শাড়িতে তনুশ্রীকে অপ্সরীর মত লাগছে। হাতে কয়েকটা কাচের চুড়ি আর কপালে একটা টকটকে লাল টিপ। ব্যাস! এটুকুই তার সজ্জা। তাতেই যেন সে ক্লিওপেট্রার সাথে রূপের প্রতিযোগিতা করার সামর্থ্য রাখে তার পাশে দাঁড়ানো উসকো খুসকো চুল আর দু’দিনের না কামানো দাড়িতে সজলকে ঠিক তনুশ্রীর পাশে মানাচ্ছে না। অবশ্য, তাকে খুব বেশি বেমানানও লাগছে না। লাল পাঞ্জাবী আর নীল জিন্সে তাকেও দারুণ মানিয়েছে।
সজল তনুশ্রীর হাত ধরে রেখেছে। তনুশ্রীর মুখের দিকে তাকাল। তাকিয়ে রইল। তনুশ্রী লজ্জা পেয়ে গেল। আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?’
-তোমাকে দেখতে পরীর মত লাগছে।
বলেই সজল পাশে তাকাল। তার পাশে দাঁড়ানো মহিলাও ঠিক তার সাথে একই কথা বলেছে। সমান বিস্ময়ে মহিলাও তার দিকে তাকাল। তারপর ঘটনা বুঝ তেপেরে দু’জনের মুখেই ভদ্রতার হাসি দেখা গেল। তুলিও বেশ মজা পেল। নতুন কিছু আবিষ্কারের মত উৎসাহে তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল,‘ওমা! আপু, তুমিও পরী! জানো আমিও একটাপরী।’
তনুশ্রী, সজল, ফাহিমা তিনজনেই হেসে ফেলল। তনুশ্রী আদুরে গলায় বলল, ‘ও! তুমি পরী?তা আমাদের পরীটার নাম কী?’
-আমার নাম তুলি। বয়স পাঁচ বছর। আমি নার্সারিতে পড়ি।
তিনজনই আবার হেসে ফেলল।
(৬)
সকাল ৮টা
নিজের কাজকর্মে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুরা সবাই যেখানে আগামী বছরটার গার্লফ্রেন্ড খুঁজছে সেখানে সে মুগ্ধ হয়ে শুনছে, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে, নাচিছে ঘূর্ণিবায়/ জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায়’। এর চেয়ে সুন্দর কোন গান পৃথিবীতে আজ অবধি সে শুনেছে কি’না সে বিষয়ে তুর্যের খানিকটা সন্দেহ হল। ছায়ানটের মূল অনুষ্ঠান শুরুই হয়েছিল ‘এসো হে বৈশাখ’ গেয়ে। গানটার প্রথম লাইন ছাড়া বাকিটুকু আগে কোনদিন শোনে নি। আজকে শুনেও বেশি কিছু বোঝে নি। কিন্তু, সুরটা এখনও হৃদয়ে গেঁথে আছে। নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেল, এতদিন চেস্টার বেনিংটনকে পৃথিবীর সেরা গায়ক ভেবে এসেছে’ বলে।
হঠাৎ খেয়াল করল পাশে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটাও গুন গুন করে গলা মেলাচ্ছে: ‘বনফুল আভরণ খুলিয়া ফেলিয়া/ আলুথালু এলোকেশ গগনে মেলিয়া’।
তুর্য খানিকটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি গানটা পুরোটা পার?’
তুহিন মাথা নাড়ল।
-প্লিজ, আমাকে লিখে দিতে পারবে?
-কেন পারব না? তোমার কাছে কাগজ কলম আছে?
তুর্য সাথে সাথে তার ব্যাকপ্যাক থেকে খাতা কলম বের করতে লেগে গেল। তুহিনের হাতে খাতা কলম দিতে দিতে বলল, ‘ওহ! তোমার নাম টাই এখনও জানা হল না।’
-ও আচ্ছা! আমি তুহিন।
-আমি তুর্য।
(৭)
সকাল ৯টা
আফজাল শান্ত থাকার চেষ্টা করছে। পারছে না। প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে। কেবলই ঘেমে চলেছে। পাঞ্জাবীটা ঘামে জবজব করছে। সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবীটা দুর থেকে দেখলে মনে হবে কালো। অবশ্য এই গরমে সবাই ঘেমে আছে বলে কেউ কিছু মনে করছে না। আফজালের প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, বুঝি এখনই সে ধরা পড়ে যাবে। কিংবা পাশ দিয়ে ডগ স্কোয়াডের কেউ যাবে। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কোন কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠবে। তাকে সার্চ করলেই সে ধরা পড়ে যাবে।
ধরা পড়া নিয়ে আফজালের কোন চিন্তা নেই। তার শুধু চিন্তা মিশন সফল করা নিয়ে। সে মরার পণ নিয়েই এসেছে। মিশন সফল হলেও সে মরবে। ব্যর্থ হলেও। সে সফল হয়েই মরতে চায়।
একবার রহিমার মুখটা কল্পনা করল। তার হাতের ইলিশ মাছ দিয়ে ডাল চচ্চড়ি আর খাওয়া হবে না। ফারুকের মুখটা ভেসে উঠল। ছেলেটাকে হাফেজ দেখে যেতে পারল না। আর মাত্র ছয় পারা বাকি ছিল। তার মাদ্রাসার প্রতিটা ছাত্রের মুখ ভেসে উঠল। তাকে খানিকটা বিভ্রান্ত মনে হল।
সে একবার পেছন ফেরে আবেদের দিকে তাকাল। এই সত্যিকারের মুসলিম পুলিশ অফিসারটা তাকে এত কঠোর নিরাপত্তা ভেদ করে ভেতরে ঢুকিয়ে না দিলে এই মিশন সফল করাই অসম্ভব ছিল। আবেদের চোখে খানিকটা তাড়া দেখা গেল।
আফজাল আবার সামনে তাকাল। হয়তো আজ থেকে কয়েক বছরপর যখন বাংলাদেশ আবারও পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে তখন সবাই শ্রদ্ধায় তার প্রতি মাথা অবনত করবে। ঠিক যেমন করে এই পথভোলা জাতি আজ স্মরণ করে একাত্তরের ভারতের দালাল, নাস্তিক আর মস্কোপন্থী বামদের। ইসলামের প্রতি শত্রুতা করে তারা পাকিস্তানকে দুই খণ্ড করে দিয়েছিল। এবার ওরা সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছে। ইসলামকে রক্ষা করতে হবে। হেফাজত করতে হবে, আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থাকে। হয়তো কিছু জীবন যাবে। তার নিজের জীবনও যাবে। যাক। তাতে কিছু আসে যায় না। সে যা করছে সব ইসলামের জন্য। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
বুকের চাপা আশঙ্কাটা খানিকটা কমল।
পাজামার ভেতরের দিকে পকেট তৈরি করে রাখা গ্রেনেডটা হাতে নিলো। লম্বা আলখাল্লার মত পাঞ্জাবীটার নিচে সেটাকে ধরে রেখে পিনটা খুলল। হাত এতটুকু কাঁপল না। মনে মনে নয় পর্যন্ত গুনল। তারপর গ্রেনেডটা ছেড়ে দিল। ঠিক তার দু’পায়ের মাঝখানে স্থির হল। এক সেকেন্ড পরে প্রচণ্ড শব্দে চারদিক স্থির হয়ে গেল।
(৮)
সকাল ৯টা ৫
ফাহিমা এখনও তার পরীটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। প্রচণ্ড ভয়ে তার দু’চোখ বিস্ফোরিত হয়ে আছে।
সজল তনুশ্রীর হাত এখনও ধরে আছে। তনুশ্রীর লাল টিপটার পাশে খানিকটা ঘাস পিসে আছে। বোধ হয়ে ভয়ার্তকেউ দৌড়ে পালানোর সময় ওর কপালটা মাড়িয়ে গেছে। লাল আর সবুজ মিশে আছে।
তুহিনের গলাটা এখনও কাঁপছে। ঠোঁট দু’টো যেন নিজে থেকেই গাইছে, ‘মনে মনে মেলে দিলেন গানের সুরের এই ডানা’। সেই গান আকাশ শুনছে, বাতাস শুনছে, গাছগুলো শুনছে। স্রেফ কোন মানুষ শুনছে না।
মাইশা শক্ত করে তার বাবার হাত ধরে আছে। তার বাবার কোমরের নিচের অংশ ছিটকে দু’হাত দুরে পড়ে আছে। তুহিনের কান্না-ভেজা চোখ দেখে নেয়া আজকের ছুটিটার কাগজটা ছিঁড়ে আংশিক বেরিয়ে আছে।
তুর্য’র হাতে এখন কাগজটা, ‘ছুটে আসে সহসা গৈরিক বরণী, বালুকার উর্ণী গায়/ জলতরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায়’।
আফজালের দেহের কোন অংশ অবশিষ্ট নেই। ডান চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে দু’হাত দুরে পড়েছে। সেই চোখে এখনও স্বপ্ন। স্বপ্নের পাকিস্তানের। বা চোখটা পুড়ে আছে। সেখানেও স্বপ্ন। বেহেশতের। আর তার ধর্মভীরু মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া, আল্লাহর সন্তুষ্টির।
Comments
Post a Comment