২৫শে মার্চ বনাম ৬ই মে
এতক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। খুব ভাল ভাবেই শুরু হতে দেখছি, গতকালের পুলিশ-র্যাব-বিজিবির সম্মিলিত অভিযানকে ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে সংঘটিত অপারেশন সার্চলাইটের সাথে তুলনা। সেটা নিয়েই কিছু যৌক্তিক কথা বলব।
প্রথমেই যাই প্রেক্ষাপটে:
২৫শে মার্চের আগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। সেখানে তিনি কিন্তু, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি। কেন দেন নি? কারণ, এর অর্থই হচ্ছে পাকিস্তানী মিলিটারির হাতে একটা ইস্যু তুলে দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু তা করেন নি।
অপর দিকে ৫ই মে সন্ধ্যায় বাবু নগরী, সরকারের উদ্দেশ্যে বললেন “কীভাবে পালাবেন পথ বের করেন।” তারও আগে বলা হয়েছিল ৫ই মে’র পর থেকে দেশ চালাবে হেফাজত। অর্থাৎ, সরাসরি রাষ্ট্রদোহীতা।
আসি নেতাদের কার্যক্রমে:
বঙ্গবন্ধু জানতেন দেশ পশুতে আক্রান্ত। যে কোন সময় তাকে গ্রেফতার করতে আসবে। তাকে গ্রেফতার করা হলে রক্ষার জন্য কেউ নেই। মৃত্যু এক প্রকার অবধারিত। কিন্তু, তবুও তিনি পালিয়ে যান নি। দেশ মাতৃকার সেবায় তিনি ছিলেন অটল অবিচল। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দৃঢ় চিত্তে অপেক্ষা করেন, পাকিস্তানী মিলিটারির জন্য।
অপর দিকে, আমাদের আল্লামা শফি আসার জন্য হেলিকপ্টার সংকটে ভুগছিলেন। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকায় তিনি মতিঝিলে আসতে পারেন নি। তার অনুসারীদের দিতে পারেন নি, বিন্দুমাত্র দিক নির্দেশনা।
আসি অ্যাকশন-পূর্ব জনতার কার্যক্রমে:
২৫শে মার্চ অ্যাকশন শুরুর আগে, প্রতিটি বাঙালি স্বপ্ন দেখছিল ভুট্টো আর মুজিবের মধ্যে সমঝোতার। তার মিটিং করছিল, মিছিল করছিল এবং স্বপ্ন দেখছিল এতদিনের বঞ্চনা আর শোষণের অন্তঃষ্টিক্রিয়ার।
অপরদিকে, গতকাল ৫ই মে হেফাজতের তাণ্ডব সারা দেশবাসী দেখেছে। ইসলামকে হেফাজতের নামে, তারা দোকান ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন, জুয়েলারি লুট, পুলিশের ওপর হামলা করেছে। এবং সর্বশেষেতারা আগুন দিয়েছে পবিত্র গ্রন্থ আল-কোরআনে।
আসি মিডিয়ার উপস্থিতিতে:
২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে দেশে কোন মিডিয়া ছিল না। না জাতীয়, না আন্তর্জাতিক। প্রত্যেকটি মিডিয়াকর্মীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
অপরদিকে ৬ই মে রাতের অ্যাকশন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সরাসরি প্রচারিত হয়েছে। একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের অ্যাকশন।
আসি পূর্বাভাসে:
২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের কথা কেউই জানত না। যদিও বাতাসে বহু গুজব ছড়ানো হয়েছিল, কিন্তু সঠিক খবর কারও কাছেই ছিল না।
কিন্তু, পুলিশ-র্যাব-বিজিবির যৌথ বাহিনী শাপলা চত্বরে ছিল বহু আগে থেকেই। তাদের বারবার বলা হয়েছিল, রাত ৩টার পর থেকে অ্যাকশন শুরু হবে। অর্থাৎ, তখনও যারা ছিলেন যৌথ বাহিনীকে অবজ্ঞা করেই ছিলেন।
আসি অ্যাকশন কারা ঘটিয়েছিল:
২৫শে মার্চের কাল রাতের আক্রমণ করেছিল, পাকিস্তানী মিলিটারি। একটি সুদক্ষ এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কিলিং স্কোয়াড।
অপর দিকে ৬ই মে রাতের অ্যাকশন ছিল পুলিশ-র্যাব-বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর। ন্যূনতম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না, ‘পুলিশকে যতই ট্রেনিং দেয়া হোক না কেন, তারা কখনই সেনাবাহিনীর মত নৃশংস হতে পারবে না’।
আসি ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্রে:
২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে ব্যবহৃত হয়েছিল, ট্যাংক, মর্টার, ভারি অস্ত্রশস্ত্র, মেশিনগান। ৯০০০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রামে ভেড়ে এমভি সোয়াত নামের একটি জাহাজ(Major Rafiqul Islam, A Tale of Millions, p57) পাকিস্তানী নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলো করাচী ছেড়ে চালনার উদ্দেশ্যে রওনা হয় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায়।
অপরদিকে ৬ই মে রাতের অ্যাকশনে যৌথ বাহিনী ব্যবহার করে গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড এবং পিপার স্প্রে।
আসি পালানোর সুযোগ দেয়ায়:
নিরস্ত্র বাঙালিকে পালিয়ে যাবার কোন সুযোগ ওরা দেয় নি। এক অবিশ্বাস্য নির্মমতায় ওরা হত্যা করেছিল, স্বদেশীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে, বুদ্ধিজীবীদের বাড়িতে গিয়ে তারা তাদের হত্যা করে। হত্যা করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যদের।
আর ৬ই মে’র অ্যাকশনে হেফাজতীদের পালানোর যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তাদের ওপর অতর্কিত হামলা হয়নি। বরং সবাইকে কান ধরিয়ে সুড়সুড় করে সরিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাবটা এমন, ‘পিচ্চি! দুষ্টামি করিস ক্যান? এখন বাড়িত যা’।
আসি অ্যাকশনের ব্যাপকতায়:
২৫শে মার্চের অ্যাকশন সংঘটিত হয় সমগ্র ঢাকা শহরে এবং পরে সারাদেশে।
কিন্তু, ৬ই মে’র অ্যাকশন কেবল মতিঝিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
আসি অ্যাকশনের উদ্দেশ্যে:
২৫শে মার্চের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল, ঠাণ্ডা মাথায় নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যার মাধ্যমে সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালির স্বাধীনতার যৌক্তিক দাবীকে বন্ধ করা।
আর ৬ই মে’র অ্যাকশনের উদ্দেশ্যে ছিল মতিঝিলকে ছাগ-বিষ্ঠার দুর্গন্ধমুক্ত করা। জিহাদি জোশ যদি সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দের উবে যায় তাহলে, তাদের তরমুজ বিপ্লবের সার্থকতা কোথায়?
=================================================
এই দশটি পয়েন্ট খুব ভাল ভাবে বুঝিয়ে দেয়, ২৫শে মার্চের সাথে ৬ই মে’র তুলনা করা কতটা অবান্তর, অযৌক্তিক, অবিবেচনা-প্রসূত এবং হাস্যকর। কেবল, সেটা বোঝার ন্যূনতম বুদ্ধিমত্তা আপনার থাকলেই হল।
ইস্টিশন ব্লগ: http://istishon.com/node/1676
Comments
Post a Comment