খেয়াল

:আলোগুলো নেভাবে?

আমি উত্তর দিলাম না। চুপ থাকলাম এবং। সাথে সাথে রাস্তার দুপাশে যতটা চোখ জ্বলে থাকা শত সোডিয়াম আলো নিভে গেল ঠিক যেমনটি তুমি চাইলে। রাস্তার কুকুরের হুঙ্কার থেমে গেল মুহূর্তের জন্য। হঠাৎ করে মুহূর্তের জন্য খানিকটা ভয় আর খানিকটা অনিশ্চয়তার তাদের মাঝে জায়গা করে নিল। তারপর লোডশেডিং ভেবে তারপর তারা আবার আদিম খেলায় মত্ত হল। 

দেখ। এখন, ঠিক এই মুহূর্তে, এই রাত সাড়ে সাতটার পথটাকে মনে হচ্ছে ঠিক রাত দু’টো। রাস্তায় গাড়ির ভীড়টা কমে গিয়ে যদি ক্ষণিকের জন্য পুরোটা হয়ে যেত, তেপান্তরের মত ফাঁকা, আর খানিক পর পর সাই সাই করে ইলেক্ট্রিক ট্রেনের বেগে ছুটে যেত একটার পর খানিক বিরতি নিয়ে আরও একটা ট্রাক কোন সন্দেহের অবকাশ থাকত না এখন রাত দু’টো। জানো তো? সময়ের হিসেব করে আলো। সেটা পনের কোটি কিলোমিটার দুরের সূর্যালোকই হোক, কিংবা হোক ১৫ ফুট দুরে থাকা সোডিয়াম আলো। ওসব আপেক্ষিকতা, গতিবেগ, ভর সবকিছু অর্থহীণ। সময় মানেই আলো।
:আর একটু নিরালা এনে দেবে?

তোমার বলার ঠিক ১১ মিলি সেকেন্ড পরে হঠাৎই এই পিচ ঢালা রাস্তা জুড়ে অগ্রসরমান যতগুলো নিম্নবিত্ত বাস, মধ্যবিত্ত রিকশা আর উচ্চবিত্ত প্রাইভেট কার ছিল, যেন কোন ব্লাক হোলের সুতীব্র আকর্ষণে নিমিষের মাঝেই মিলিয়ে গেল শূণ্য মাত্রায়। তুমি তৃপ্তির হাসি হেসে আমার দিকে চাইলে। চাইছিলাম তোমার চোখে খানিকটা বিস্ময়ের ছোয়া থাক। আমি তা দেখি নি। তুমি রাখ নি। বরং আমার চোখে ছোয়া ছিল একরাশ মুগ্ধতার। ভালবাসায় তোমার এতটা বিশ্বাস?

ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় এসে দাড়ালাম। আমার হাত ধরে নেমে এলে তুমিও। মাথার ওপরে শূণ্যে ভেসে থাকা ফ্লাইওভারটার দিকে তাকালাম। এবং আবার অসীমে দৃষ্টি ফেরালাম। হ্যাঁ, পথটা তো অসীমই।

:আমি আকাশ দেখব। আমি দেখব চাঁদ। আর তার মাঝ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা কোমল সূর্যালোক। দেখাবে?

আকাশ আর আমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাড়িয়ে থাকা, ফ্লাইওভারটা মুহূর্তে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। মৃদু হাসলাম। মৃদু হাসলে। সেখান থেকে দৃষ্টি ছড়িয়ে গেল অনেক খানি দুরে খেলে বেড়ানো একরাশ ধোয়াশা মেঘের দিকে। চাঁদ আর আমার দৃষ্টির মাঝে অবস্থানের ধৃষ্টতা ওরা দেখিয়েছিল। এক পলক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি মেলতেই, ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা মেঘগুলো একসাথে জড়ো হয়ে, মুহূর্তে যেন কোন দৌড় প্রতিযোগিতায় শামিল হয়ে সরে গেল চাঁদের চারপাশ থেকে। চাঁদটা উঁকি দিল লাজুক মুখে। লক্ষ কিংবা কোটি বছর ধরে পৃথিবীটার চারপাশে অনবরত ঘোরার পরেও আজকেও তাকে কতটা নতুন লাগছে, ভেবে অবাক লাগে। এরপর; চাঁদের পাশ থেকে দুরুদুরু বুকে কয়েকটা তারা। লক্ষ কোটি আলোক বর্ষ পেরিয়ে প্রথম বার মাটির পৃথিবীতে তার আলো ফেলল। তাদের মুখে দাম্ভিক বিজয়ীর হাসি। নিভূ নিভু আলোয় তা চোখে পড়ল না। তার পেছনে আরও শত সহস্র লক্ষ কোটি তারা আলো ফেলার অপেক্ষা ছুটে আসছে। 

চাঁদটা এগিয়ে আসছে মাঝ আকাশের দিকে। ঠিক আমাদের মাথার ওপর। মেঘগুলো মাঝে মাঝে চেষ্টা করছে ওকে ঢেকে দিতে। আবার ভয় পেয়ে সরে যাচ্ছে। 

স্বর্গ হতে নেমে আসা কোন এক অপ্সরির মায়াময় হাতটি ধরে, এই অসীমে বিস্তৃত পথে অসীমের স্বপ্ন দেখে, কতক অসীম পদক্ষেপে...

:আর একটু নিঃশব্দ এনে দেবে?

ঠিক তার সাথে সাথে সময় স্থির হয়ে গেলে যতটা নিঃশব্দ হয় পৃথিবী, তার চেয়েও নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল শব্দের তরঙ্গগুলো। কিংবা এও হতে পারে, তোমার মুখে ‘নিঃশব্দ’ শব্দটি শুনে আমি হারিয়ে ফেললাম শব্দকে অনুভব করার যতটা স্নায়ু আছে আমার মাঝে। হয়তো বা অডিটরি স্নায়ু হতে শ্রবণের উদ্দীপনা সেরেব্রাম অবধি পৌছানোর আগেই তা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। ঠিক কী ঘটেছিল আমি জানি না। কিন্তু, এটুকু আমি নিশ্চয়তা দিয়েই বলতে পারি, আমি আর কোন শব্দ শুনিনি। স্রেফ তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া।

কোন নিঃশ্বাসের শব্দে এতটা সম্মোহন লুকিয়ে থাকতে পারে, আমি কখনও ভাবি নি। সত্যি বলছি, আমি কল্পনাতেও কখনও ভাবি নি এমন একটি মুহূর্ত আমার জীবনে আসবে। আমার জীবন সার্থক; সার্থক আমার মরণ। সার্থক হয়েছে, যদি এদুভয়ের বাইরে কিছু থেকে থাকে সেটাও।

:আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবে?

ঠিক সেই মুহূর্তে আমি তোমাকে আলিঙ্গন করলাম। এবং অনুভব করলাম সমগ্র মহাবিশ্বকে। অনুভব করলাম স্রষ্টাকে, তার সৃষ্টিকে। যতটা জরা, মৃত্যু, বেদনা, কাম, লালসাকে পাশ কাটিয়ে আমি হৃদয়ের মাঝে রেখে দিলাম ভালবাসার ছোট্ট এবং কামনাহীন একটি ফড়িং। 

খেয়ালের ফেরে সাত সমুদ্দুর তের নদী পার করে কোন এক চন্দননগরের চৌকাঠে পা রেখে, আমি দেখলাম প্রাসাদের চূড়ায় এলোচুলে দাড়িয়ে থাকা রাজকণ্যা। দেখলাম, তার মাথার ওপরে একই সাথে চন্দ্র-সূর্যের মিলন। দেখলাম পৃথিবীর যত হিংস্রতা, ক্রোধ আর দ্বেষ এসে ভালবাসায় নিঃশেষ হয়ে যেতে। 

দেখলাম রাতকে; তার উন্মত্ততাকে। দেখলাম তোমাকে; আলিঙ্গন করলাম। অনুভব করলাম। খেয়ালের ফেরে তোমায় নিয়ে আমি বিশ্বজয় করলাম। এই পীচঢালা, অন্ধকার, অসীম রাজপথে। আমার ছোট্ট রাজ্যের বিশাল প্রাসাদে থাকবে কী?

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক