নির্দ্বিধায়...
(২)
-রাইসা, মাছের কাঁটা খায় বাইছা বাইছা।
:শালা কুত্তা! পচাইতে চাইলে নিজে কিছু বানাইয়া পচাবি। জাফর ইকবালের লাইন চুরি করে পচাস ক্যান? নিজের কিছু করার সাধ্য নাই?
-হে হে হে! আমি তো VIP মানুষ। তোরে পচানোর জন্য বসে বসে ছড়ার লেখার টাইম আছে না'কি আমার? তাই, খোদ জাফর ইকবালই আমার হয়ে তোর নামে পচাইয়া ছড়া লিখে ফেলাইছে।
:শালা কুত্তা!
রাইসা গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার এখন কান্না পাচ্ছে। প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। তমালটা এমন কেন? সবসময় তাকেই পচাবে। ও কি কিছু বোঝে না? ছেলেরা এত বোকা হয় কেন? পৃথিবীর আর কেউ যা খুশি বলুক, রাইসার কিছু আসে যায় না। কিন্তু, তমালের সামান্য একটা কথা রাইসার কাছে অনেক কিছু। আচ্ছা, তমালের একটা কথা রাইসার কাছে অনেক কিছু কেন? রাইসার নিজের ওপর রাগ লাগতে শুরু করেছে। মরার কান্নাটাও থামছে না। কেউ যদি এখন দেখে ফেলে, এই বুড়োধাড়ি মেয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে, কি কেলেঙ্কারিটাই না হবে!
হঠাৎ কে যেন, পেছন থেকে রাইসার পিঠে হাত রাখল। রাইসা পেছন ফিরে দেখল তমাল। তাড়াহুড়ো করে চোখ মুছল।
-রাগ করছিস?
:ভাগ কুত্তা।
-ওরে বাবা! এখনও এত রাগ?
:কুত্তা! কুত্তা! কুত্তা! তোরে এখান থেকে যেতে বলছি। আর জীবনে কোনদিন আমার চোখের সামনে আসবি না।
-দোস্ত, আগামী সপ্তাহে আমরা সবাই স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছি। যাবি?
:কুত্তা, তোরে এখান থেকে যাইতে বলছি?
-আর যদি স্টাডি ট্যুরটা হয়, শুধু তোর আর আমার?
রাইসা প্রথমে অবাক হয়ে তমালের দিকে তাকাল। তারপর, তমাল আসলে কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরেই ওপর রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়ল, “সত্যি!”
-হ্যাঁ, সত্যি।
:শুধু আমরা দু’জন?
-হ্যাঁ, শুধু আমরা দু’জন।
:কু-ত-তা!!!
-কি! এখনও কুত্তা!
:না এখন কুত্তা না। পাপি! একটা কিউট পাপি!
(৩)
-ফরিদপুর। আমাদের একটা বাংলো বাড়িতে।
:তোদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর?
-নাহ! যুদ্ধের সময় বাবার ট্রান্সফার ছিল ফরিদপুরে। ওই এলাকার দারোগা আই মিন সাব-ইন্সপেক্টর। সেখানকার তখনকার জমিদারেরা বাবার কাছে বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল।
:কেউ থাকে না, এখন সেখানে?
-নাহ!
রাইসা বাইরের দিকে তাকাল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। কিংবা এখনও হয় নি। আকাশ ভরা মেঘ প্রকৃতিটাকে সন্ধ্যামুখর করে রেখেছে। টিপটিপ করে বৃষ্টি গাড়ির উইন্ড-শিল্ডে আছড়ে পড়ছে। রাস্তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। মাত্র সেখানে ধান রোয়া হয়েছে। ধানের সবুজে কচি উজ্জ্বলতাটা এখনও যায় নি। মাঠ পেরিয়ে দুরে একসারি গ্রাম। সেখানে টিমটিম করে হ্যারিকেন আর কুপিবাতি জ্বলছে। দেখে মনে হচ্ছে, আকাশের তারাগুলো যেন দূরের গ্রামে নেমে এসেছে।
তমাল বিড়বিড় করে বলল-
এইখানের গ্রামগুলো তখন ঘুমিয়ে গেছে।রাইসা মুগ্ধ হয়ে শোনে। এই ছেলেটার সবকিছুই তাকে এমন মুগ্ধ করে কেন? রাইসা নিজের ওপর বিরক্ত হতে শুরু করে। মুগ্ধতার বিরক্তি।
একটা সূর্য ডুবে_
শত সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলেছে ষোড়শী নববধূর হাতে;
দুয়ারে দুয়ারে।
(৪)
দু’পাশের বিশাল গাছগুলো সড়কটাকে ঢেকে রাখে ভর দুপুরেও। মধ্য আকাশের রোদও পৌছুতে পারে না নিস্তব্ধ সড়কটায়। ডান পাশে একটা পুকুর। ঘাট বাধানো। এখন অবশ্য ভেঙে পড়েছে। দেখে দেখে পা ফেলতে হয়। রাইসার খানিকটা অবাক লাগে। একেবারে মূল সড়কের পাশেই পুকুর। এখানেই নিশ্চয়ই জমিদার বাড়ির মেয়েরা গোসল করতে আসত। আর এই সড়কটা এই এলাকার প্রধান সড়ক। একটু পরপরই নিশ্চয়ই লোকজন আসা যাওয়া করত। ভাবনাটাকে বেশি প্রশ্রয় দিল না।
পুকুরের পাশেই মন্দির। মন্দিরের দেবীর কোমরের ওপরের অংশ দেখা গেল না। পাশে একটা সিংহের মাথাটা দেখা গেল না। বাকি সবকিছুরই একই রকম ভগ্নদশা।
রাইসা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কি রে, তুই কি আমাকে কোন ভূমিকম্প আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনে আনছিস না’কি? সবকিছুর এমন ভাঙাচোরা অবস্থা কেন?’
তমাল কোন উত্তর দিল না। দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল।
রাইসা আবার জমিদার বাড়ি দেখায় মনোযোগ দিল। মূল বাড়িটা সড়কের ডান পাশে বেশ অনেক খানি জায়গা নিয়ে করা। হঠাৎ খেয়াল করল, সড়কের বা পাশে মানে মন্দিরের পাশেও কয়েকটা থাকার ঘর। সারি সারি তুলসী গাছের ডিবির কারণে সহজে চোখে পড়ে না। তার মানে, সড়কটা আগে ছিল না। পুরো বাড়িটা একত্রেই ছিল। মেয়েদের গোসলের ব্যাপারটা এখন নিশ্চিত হওয়া গেল।
রাইসা মূল বাড়িটার দিকে এগোল। মূল গেটটা খোলা হয় নি। পেছনে আর একটা গেট আছে। ওটা দিয়ে ঢুকতে হবে। পেছনে গাছগাছালি বেশি। ঢোকার জন্য বেশ বড় একটা করিডোর। পুরোটাই প্রায় অন্ধকার। উঁচু সিলিং তো দেখাই যায় না অন্ধকারে। ঢোকার সাথে সাথে রাইসার নাকে একটা বোটকা গন্ধ এসে লাগল। রাইসা বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর এই বাড়িতে ভূমিকম্প হবার সময় মানুষ মরেছিল না’কি? গন্ধ কীসের?”
তমাল রহস্যজনক গলায় বলল, “দেখে ভয় পাবি না তো?”
রাইসা তীব্র চোখে তমালের দিকে তাকাল। তমাল পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালাতেই ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় উড়ে বেরিয়ে গেল। রাইসা রীতিমত চিৎকার করে উঠল ভয়ে। শখানেক বাদুড়ের কিচির মিচিরে একটা ভয়াবহ আওয়াজ তৈরি হল। রাইসা ভয়ে তমালকে জড়িয়ে ধরল। সব বাদুড় চলে যাবার পরেও মিনিট দুয়েক লাগল রাইসার ধাতস্থ হতে।
ধাতস্থ হবার পর তমালের বুকে ক্রমাগত ঘুষি মারতে মারতে বলল, “কুত্তা! এইভাবে কেউ ভয় দেখায়। তুই... তুই... তুই...”
তমাল কিছু বলল না। হালকা একটা হাসি দিয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করে সামনে এগোল। করিডোর পার হয়ে মূল বাড়িতে ঢুকতেই রাইসা রীতিমত ধাক্কা খেল। ছয় সাতটা রুমের ভেতরের অংশ একেবারে নতুন করে তৈরি করা। টাইলস ঝকঝক করছে। এয়ার কন্ডিশন্ড রুম। ওপরে সুদৃশ্য ঝাড়বাতি। পুরনো আমলের নকশাদার বিছানা। একেবারে রাজকীয় অবস্থা বলা যায়।
রাইসা রীতিমত মুগ্ধ হয়ে যায়। বিস্মিত গলায় বলে, “এত কিছু! আমার জন্য?”
-হ্যাঁ, তোর জন্য। তুই আমার খুব ভাল একটা বন্ধু রে।
রাইসা মিটিমিটি হাসতে বলল, “শুধু ভাল একটা বন্ধুই? এর বেশি কিছু না?”
তমাল নিঃস্পৃহ গলায় উত্তর দিল, “তুই আমার শুধু বন্ধুই। আমি চাই আমার বন্ধুর জীবনের শেষ সময়টুকু সুন্দর কাটুক।”
রাইসা চমকে উঠে তমালের দিকে তাকাল।
(১)
নূপুর বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। ইচ্ছে করছে, ছেলেটার গালে ঠাস করে একটা চড় মারতে। এতটা আত্মসম্মানহীন মানুষ কীভাবে হয় নূপুর ভেবে পাচ্ছে না। প্রতিদিন ভার্সিটির সামনে এসে সেই একই কথা।
তমালের অবশ্য কোন বিরক্তি নেই। নূপুরের জন্য সে প্রয়োজনে সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারে। যতদিন নূপুর হ্যাঁ না বলবে, ততদিন। মেয়েটা এতটা নিষ্ঠুর কেন? নিষ্ঠুর! না’কি বোধহীন? তমাল তাকে পাগলের মত ভালবাসে সে কি সেটা বোঝে না?
নূপুর ঝাঁঝালো গলায় বলল, “প্লিজ, আপনি আর এখানে দাড়িয়ে সিন ক্রিয়েট করবেন না। এখন এখান থেকে যান তো।”
-আমি তো চলে যাবই। শুধু তুমি একবার বল, ভালবাসি।
:আশ্চর্য! ভালবাসা কি এভাবে হয় না’কি?
-তাহলে কীভাবে হয়? বল আমাকে। তোমার জন্য আমি পৃথিবীর সবকিছু করতে পারি।
নূপুর একটু থমকে দাঁড়ালো। তার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। ছেলেটার যন্ত্রণা বন্ধ করার বুদ্ধি দেখা যাক, সেটা কাজে দেয় কি’না। বন্ধ না করা গেলেও অন্তত ভড়কে দেয়া যাবে।
:আপনি আমার জন্য সবকিছু করতে পারবেন?
-হ্যাঁ, সবকিছু। তুমি শুধু একবার বলেই দেখ।
:জানেন, আমি না সাইকো থ্রিলারের ডাই হার্ড ফ্যান। তাই আমি ঠিক করেই রেখেছি, আমি ভালবাসবো এমন একজনকে, যে হবে সার্থক সাইকোপ্যাথ। নির্দ্বিধায় যে মানুষ মেরে তার কাঁচা মাংস গপাগপ খেয়ে ফেলতে পারবে এমন কাউকে। আপনি আগে কাউকে খুন করে তার কাঁচা মাংস গপাগপ করে খান। তারপর, আমি আপনাকে ভালবাসব।
(৫)
হ্যালো নূপুর, আমি তমাল বলছি। এইমাত্র আমি একটা মানুষকে খুন করেছি। রাইসা, আমার ফ্রেন্ড। এখন বসে বসে ওর মাংস খাচ্ছি। বেশ শক্ত। ছেড়া যায় না। তাই গপাগপ করে খেতে পারছি না। আর স্বাদও বিতিকিচ্ছিরি। তবে ব্যাপার না। আমি ঠিকই খেয়ে ফেলব। এবার তুমি আমাকে ভালবাসবে তো?
Comments
Post a Comment