দানব



চিহার সুন্দর দেহটা যখন আমার চোখের সামনে থেঁতলে গেল, আমি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাই নি। ঠিক করে বললে, আমার মাঝে কোন প্রতিক্রিয়া হয় নি। এখন আর এসবে কোন অনুভূতির জন্ম হয় হয় না। চোখের সামনে প্রতিদিন অহরহ ঘটতে দেখছি। এখন আর এসব হৃদয়ে কোন আঁচড় কাটে না। অবশ্য ভেবেছিলাম, চিহার মৃত্যু আমাকে একটু হলেও কষ্ট দেবে। কিন্তু, আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি একটুও কষ্ট পাই নি। ভালই হয়েছে। পুরোপুরি বোধহীন হতে পেরেছি।

ছোট বেলায় কেন এতটা বোধহীন ছিলাম না সেটা ভেবে আফসোস হয়। ছোট বেলায় এই জিনিসটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। আমি কষ্ট পেয়েছিলাম, যখন আমার মা আমাকে আরও কয়েকটা ভাই উপহার দেবার প্রত্যাশায় পুষ্টি সংগ্রহ করতে গিয়ে থেঁতলে গিয়েছিল। হয়তো ততটা নয়, কিন্তু আমি সেদিনও কষ্ট পেয়েছিলাম, যেদিন তিরুন আমাকে দেখিয়েছিল, আমার বোনের বীভৎস দেহ। আমার চোখ ভেঙ্গে কান্না এসেছিল। আমি কাঁদি নি। কারণ আমি খুব ভাল করেই জানি, এমন কষ্টগুলো আমাকে পেতে হবে। প্রতিনিয়তই পেতে হবে। প্রতিমুহূর্তে পেতে হবে। আমার হৃদয়ের প্রতিটি অংশকে দানবগুলো থেঁতলে দেবে। কিন্তু, আমাকে কিছু করবে না। এই যন্ত্রণার বিষাক্ত অনুভূতিগুলোকে নিয়ে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। অনুভূতিগুলো আমাকে একটু একটু করে দগ্ধ করবে। কিন্তু, হত্যা করবে না। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে জীবন্মৃত হয়ে।


এই দুঃসহ অনুভূতিগুলোর ভয়েই, আমি ঠিক করে ফেলেছিলাম এই ছোট্ট জীবনটায় কখনও কারও সাথে বাধনে জড়াব না। অনেকদিন পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা রেখেছিলাম। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত পারি নি। হয়তো, প্রকৃতিই ঠিক করে রেখেছিল, আমার পুরোটা জীবন সে যন্ত্রণা-কাতর করে তুলবে। হয়তো, তাই আমি দেখেছিলাম চিহাকে। প্রথম দর্শনে ভালবাসা বলে কিছু আছে কি’না জানি না। থেকে থাকুক বা না থাকুক, আমার তাই হয়েছিল। আমি শুধু এক পলক দেখেছিলাম, চিহার কাকচক্ষু জলের মত চোখগুলো। এবং আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। আমি শুধু এক পলক দেখেছিলাম চিহার তেপান্তরের মত উচ্ছলতা। এবং আমি তাকে ভালবেসেছিলাম। আমি শুধু এক পলক দেখেছিলাম চিহার ডানা মেলে পরীর মত উড়ে বেড়ানো। এবং আমি তাকে ভালবেসেছিলাম।

আমি কোন বাধনে জড়াতে চাই নি। কিন্তু, কিভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি নিজেই জানি না। জন্মের পর আমি বাবাকে দেখি নি। আমার মা আর বোন দানবদের নৃশংস নিষ্ঠুরতায় আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আমার প্রতি কখনও কারও ভালবাসাই পূর্ণতা পায় নি। তাই ভালবাসার বড় বেশি কাঙাল ছিলাম আমি। তাই কোন ‘ঝাঁকড়া চুলের বট’এর পাতায় বসে যখন চিহা শুনত আমার জীবনের কাহিনী আর তার চোখগুলো বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ত, আমি শিশুর মত ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতাম শিশুর মত পবিত্র মুখটা। আমি তেপান্তরের মাঠে হারিয়ে যাওয়া কোন উদ্‌ভ্রান্তের মত চেয়ে দেখতাম, চিহার চোখের জ্বলজ্বলে অশ্রুগুলো। অশ্রুও এতটা ভাল লাগার হতে পারে, কে ভাবতে পেরেছিল?

আমার প্রতিমুহূর্তে ভয় ছিল, এই বুঝি চিহা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। তাই, তাকে নিয়ে আমি পারতপক্ষে দানবদের এলাকা মাড়াতাম না। কিন্তু, দুরন্ত চিহা আমার কথা শুনত না। এই মাঠ, ঘাট, জঙ্গল, পুকুর সব কিছু ওর দেখা হয়ে গেছে। তাই নতুন কোথাও বেড়াতে ও বারবার ছুটে যেত, দানবদের এলাকায়। দানবরা ওকে দেখামাত্র পিশাচের মত এগিয়ে আসত ওকে থেঁতলে দিতে। কিন্তু, ওর পরীর মত ডানার জাদু ওকে বারবার বাঁচিয়ে দিত।

ওকে দানবদের এলাকায় যেতে দেখলেই, আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যেত। আমি দুর থেকে প্রতিমুহূর্তে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। প্রতিমুহূর্তে মনে হত, এই বুঝি আমি আমার সবকিছু হারিয়ে ফেললাম। চিহাকে কি করে বোঝাই, ওকে আমি কতটা ভালবাসতাম! ও বুঝত না এবং বুঝতেও চাইত না। হয়তো, ও আমার থেকেও বেশি বোধহীন ছিল। নিজের নিদারুণ পরিণতিকেও স্বীকার করে নিয়েছিল। তাই, ওর মাঝে মৃত্যুভয় ছিল না। ও জানত, ওর জন্মই হয়েছে দানবদের হাতে থেঁতলে যাবার জন্য। তাই মেনে নিয়েছিল নিজের ভাগ্য। আর সেই নিষ্ঠুর ভাগ্যের সাথেই খেলতে ও সবথেকে বেশি ভালবাসত। মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যেত তাকে আলিঙ্গনের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।

কিন্তু, আমি এতটা সাহসী ছিলাম না। আমি ভীতু ছিলাম। প্রচণ্ড রকমের ভীতু ছিলাম। সবকিছু হারিয়ে পাওয়া চিহাকে হারানোর মত সাহস করার সাহসও আমার কোনদিন হয় নি। আর আমি চাইতামও আমার এতটা সাহস হোক। অথচ, আমি খুব ভাল করেই জানতাম চিহাও একদিন থেঁতলে যাবে।

প্রকৃতি না’কি সাম্যাবস্থা পছন্দ করে। তাই খুব বেশির সাথে খুব কম মিলিয়ে দিয়ে দু’টোকে সাম্যাবস্থায় রাখার চেষ্টা করে। অন্যদের ক্ষেত্রে কি হয় জানি না, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এমনই কিছু ঘটেছিল। ঘটনাটা হচ্ছে প্রচণ্ড সাহসী চিহার সাথে প্রচণ্ড সাহসী আমার বিয়ে।

যেদিন আমি বুঝতে পারলাম, আমার বন্ধনে না জড়ানোর প্রতিজ্ঞা আমি অনেক আগেই ভেঙ্গে ফেলেছি, সেদিন আমি ঠিক করলাম, চিহাকে আমি বিয়ের কথা জানাবো। প্রচণ্ড ভীতু আমার জন্য সেটা ছিল অনেক সাহসের কাজ। কিভাবে আমি এতটা সাহস জোগাড় করেছিলাম, ভাবলে আজও অবাক হয়ে যাই। হয়তো, ভালবাসা নিজের ভাণ্ডার হতে আমাকে এতটা সাহস ধার দিয়েছিল।

যেভাবেই হোক, চিহাকে আমি বলেছিলাম, ওকে আমি বিয়ে করতে চাই। ও রাজি কি’না? চিহা কোন উত্তর দেয় নি। শুধু ওর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু আমার বুকে পড়েছিল। আমি জানি, সেই অশ্রুতে কোন কষ্ট ছিল না। আনন্দের বাষ্পগুলো একটু একটু করে জমে জলকণা হয়ে চিহার নেত্র ছুঁয়ে আমার বুকে এসে পড়েছিল। এবং আমি পেয়েছিলাম আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ক্ষণ।

খুব সাদামাটা নিরিবিলি একটা সংসার ছিল আমাদের। একটা টলটলে পুকুরের পাশে। বড় বড় গাছের ছায়ায় সূর্যের আলো খুব একটা সুবিধে করতে পারত না। আধো আলো-ছায়ার স্যাঁতস্যাঁতে আর শ্যাওলা ওঠা সেই ঘরটার মাঝে আমাদের দু’জনের যেটুকু সুখ ছিল, শব্দ তা ধারণ করতে পারে না। এত ছোট একটা ঘরে সুখের কোন অভাব আমাদের ছিল না বললেই চলে। কিন্তু, যেটুকু অভাব ছিল, সেটা পূরণের কথা চিন্তা করলেও আমার বুক কেপে উঠত। আমাদের অভাব ছিল শুধু একটা জিনিসেরই। সন্তান। চিহার খুব শখ ছিল সন্তানের। সেটা আমারও কিছু কম ছিল না। কিন্তু, সন্তান জন্ম দিতে দরকার পুষ্টি। পুষ্টি আছে রক্তে। এবং রক্ত আছে দানবের দেহে।

চিহার খুব শখ ছিল একটা সন্তানের। সেটা আমারও কম ছিল না। কিন্তু, সেটা বাস্তব করার চেষ্টা করার মত সাহস আমার ছিল না। চিহার ছিল। কেন ছিল, কিভাবে ছিল আমি জানি না। কিন্তু, ছিল।

তাই, চিহা যেদিন আমাকে ওর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল আমি বিন্দুমাত্র অবাক হই নি। আমি ওকে অনেক অনুনয় করেছি, এমনটা না করার। ওকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু, অবাক হই নি। কারণ, আমি খুব ভালভাবেই জানতাম চিহা একদিন এমনই কিছু সিদ্ধান্ত নেবে।

শেষ বিদায়ের মুহূর্তে আমি চিহাকে কিছু বলি নি। কারণ, বিদায়ী কিছু বলার অর্থই হচ্ছে বিদায়টাকে স্বীকার করে নেয়া। আমি তাকে স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলাম না।

আমি ভীতু ছিলাম। প্রচণ্ড ভীতু ছিলাম। কিন্তু, তাই বলে চিহাকে একাও ছেড়ে দিতে পারি নি। হয়তো তার সাথে নয়। ওর হাতে ধরে মৃত্যুকে বরণ করার মত সাহস আমার ছিল না। কিন্তু, আমি গিয়েছিলাম ওর সাথে। আমি ওকে দেখেছিলাম, মশারীর ছেড়া অংশটা দেখে ভেতরে ঢুকে যেতে। পাশে জানালার কাছে উড়তে উড়তে আমি দেখেছিলাম, সন্তর্পণে ডানহাতে বই ধরে রাখা দানবটার বা হাতে গিয়ে বসতে যেন ডান হাত দিয়ে ওকে পিসে ফেলতে না পারে। হ্যাঁ, আমি সেটাও দেখেছিলাম, যখন চিহাকে রক্তপানে মগ্ন দেখে দানবটা নিঃশব্দে তার ডান হাতের বইটা বিছানায় ফেলে দিয়েছিল। আমি তার মুখের ক্রুর হাসিটা দেখেছিলাম এবং দেখেছিলাম তার নির্দয় মনের বীভৎস ছবিটা।

ঠিক পর মুহূর্তে আমি দেখেছিলাম, চিহার থেঁতলানো সুন্দর দেহ।

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক