ফেলানী, মায়াকান্না, চিৎকার এবং...

ইরফান সাহেব আজ একটু বেশিই ক্লান্ত। অফিস আওয়ারের পরেও আরও প্রায় ঘণ্টা-খানেক ছিলেন অফিসে। বিশেষ কোন কাজ ছিল না। কিন্তু, আলোচনাটা এমন জমে উঠল, তিনি আর উঠতে পারলেন না।
বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বেডরুমে ঢুকেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলেন। তার ত্রিশোর্ধ্ব স্ত্রী শামীমা বিছানায় কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন? সাথে সাথে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছ কেন?”
শামীমার কান্না যেন থামেই না। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে গেল।

ইরফান সাহেব আরও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “আহা! কী হয়েছে, বলবে তো না’কি?”
নাকের জল চোখের জল এক করে শামীমা যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে, সে নিয়মিত যে ছয়টা সিরিয়াল দেখত, তার একটার নায়িকা পৃথিলার আজকে হাতে গুলি লেগেছে।

ইরফান সাহেব যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। কিন্তু, মুখে সেটা বুঝতে দিলেন না। কপট হাহাকার ফুটিয়ে বললেন, “আহা! কীভাবে লাগল গুলি?”
শামীমা আবার উত্তর না দিয়ে ভ্যাআআ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতেই বলল, সে সিরিয়ালের নায়ক অমিতের সাথে বিয়ে করতে পালিয়ে যাচ্ছিল। অমিতের বাবা পুলিশ লাগিয়েছিল। পুলিশ ওদের থামাতে অমিতের বাইকের চাকায় গুলি করেছিল। সেই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পৃথিলার হাতে লেগেছে।
ইরফান সাহেব ভেবে পেলেন না, চাকায় গুলি করতে গেলে এতটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হাতে কেন লাগবে? আর লক্ষ্যভ্রষ্টই যদি হবে, তাহলে সোজাসুজি ওপরে নায়িকার পিঠে লাগার কথা। তাও হয় নি। তার চেয়ে বড় কথা, রাস্তার মধ্যে এত বাজে নিশানার কেউ গুলি করার ঝুঁকিও নেবে না। অন্য কারও গায়ে লাগলে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত। তার চেয়ে বড় কথা, নায়ক নায়িকা কোন অপরাধী না। তাদের উদ্ধার করতেই পুলিশ পাঠানো হয়েছে। পুলিশ কী বুঝে গুলি করল? তিনি জানেন, এতগুলো প্রশ্নের কোনটাই শামীমার মাথায় জন্মে নি। জন্মালে সে এই অখাদ্য সিরিয়াল দেখত না। কিন্তু, শামীমাকে এসব জিজ্ঞেস করা যাবে না। সে রেগে আগুন হয়ে যাবে। তিনি মোলায়েম গলায় বললেন, “যা হবার হয়ে গেছে। এখন আর এসব নিয়ে কান্নাকাটি করে কী হবে? যাও ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।”
শামীমা বেরিয়ে গেল।
তিনি রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল পালটালেন। জি বাংলা। সেখানে এখন দাদাগিরি হচ্ছে। তার প্রিয় রিয়েলিটি শো। কিন্তু, দেখার ভাগ্য হল না। অমিত ঘরে ঢুকল। এই অমিত সিরিয়ালের নায়ক অমিত না। ইরফান শামীমার একমাত্র ছেলে। সিরিয়ালের নায়কের সাথে মিলিয়ে শামীমা ছেলের নাম রেখেছিল। অমিতের বয়স এখন ছয় বছর। সেই সিরিয়ালের নায়কের প্রেম এখনও শেষ হয় নি। এখন নাকি কেবল বিয়ের জন্য পালিয়েছে।
অমিত এসেই তার বাবার হাত থেকে রিমোট নিয়ে গেল। ইরফান সাহেব প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। কিন্তু, কিছু বললেন না। কিছু বললেই অমিত চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে। অমিত চ্যানেল পাল্টে কার্টুনে দিল – ছোটা ভীম। তার প্রিয় কার্টুন।
ইরফান সাহেব বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লেন। অফিস শেষের আড্ডায় তিনি বলতে গেলে কিছুই বলতে পারেন নি। রাজ্জাক সাহেব একেবারে মধ্যমণি হয়ে ছিলেন। তিনি আবার রাজনীতির খবরাখবর বেশি রাখেন।
শামীমা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “আজকে এত দেরি হল যে!”
-আরে আড্ডাটা এমন জমে গিয়েছিল, আর উঠতে ইচ্ছে হল না।
:কী নিয়ে আড্ডা দিলে?
-ওই যে ফেলানী না কোন মেয়ে। ওর খুনির তো ফাঁসি হয় নি।
:ফেলানী কে এটা?
-একটা বাচ্চা মেয়ে। কিছুদিন আগে খুন হয়েছিল।
:রেইপ কেস? কমবয়সী মেয়েদের এসব বেশি হচ্ছে। রেইপ করে মার্ডার করে ফেলে।
-জানি না শিওরলি। তবে গুলি করে খুন করেছে নাকি। রেইপ কেসে তো গুলি করে খুন করবে না। আর খুন করার পর নাকি কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রেখেছিল।
:তাহলে বোধ হয় কোন স্কুল-স্টুডেন্ট হবে। স্কুল গুলোর তো অনেক সময় কাঁটাতারের বেড়া থাকে। কোন টিচার হয়তো রেইপ করে খুন করে ঝুলিয়ে রেখেছিল। গুলি করেছিল, যাতে কেউ রেইপ কেসের সন্দেহ না করে।
-হতে পারে।
:বাদ দাও এসব। অ্যাই শোন, তুমি একটু নামাজ পড়ে পৃথিলার জন্য দোয়া কোরো। কেমন? মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়!
ইরফান সাহেব আবার বিরক্ত হলেন। তবু মুখে মুখে বললেন, “ঠিক আছে করব।” মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, আজ রাতেই পত্রিকা ঘেঁটে ফেলানী নিয়ে সবকিছু খুঁটিনাটি জেনে নিতে হবে। কালকের আড্ডায় কিছুতেই ভাঁড় গোপাল হয়ে বসে থাকা চলবে না।

**********************************
এটুকু লিখে সাফকাত আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো। ভালই হয়েছে। শ’পাঁচেক লাইক দেখতে দেখতে উঠে যাবে। ক’টা পেইজে শেয়ার হবে কে জানে? ভাবতে ভাবতে সাফকাত গানের ভলিউমটা আরেকটু বাড়িয়ে দিল। “সুন রাহা হে না তু” বাজছে ফুল ভলিউমে। ফেলানীও দুঃখের বিষয়। এটাও দুঃখের গান। বেশ মিলেছে।
হঠাৎ মনে পড়ল আজকে তানিয়ার জন্মদিন। এখনও গিফট কেনা হয় নি। “ওহ শিট!” বলেই সাফকাত বেরিয়ে পড়ল। মাসাককালি ড্রেসটা তানিয়ার অনেক পছন্দের। সেটাই গিফট দেবে। বের হতে হতে Axe Body Spray দিয়ে নিলো। নিচে নেমেই সাফকাত তার হিরো হোন্ডা ছোটাল বসুন্ধরা সিটির দিকে।
**********************************
ব্লগার ক্লান্ত কালবৈশাখি বড় বড় দু’টো নিঃশ্বাস নিলো। ইদানীং হাঁপানির উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। আগে বেশি হাঁটলে নিঃশ্বাস নিতে পারত না। এখন কিছু লিখতে গেলেও দম আটকে আসে। সিগারেটটা ছাড়ি ছাড়ি করেও ছাড়া হচ্ছে না। ছাড়া দরকার।

পুরো লেখাটায় চোখ বুলিয়ে নিলো। খারাপ হয় নি। টুইস্টটা বেশ ভালই হয়েছে। আর মোটামুটি সবকিছুই উঠে এসেছে। এয়ারটেল সিম বর্জনের কথা লিখতে চেয়েছিল। কিন্তু, লেখা হয় নি। কারণ, তার নিজের পকেটে টাকা না থাকায় সে নিজেই এখনও তার সিম বদলাতে পারে নি। তার বাবারও বাজাজ এর মটর সাইকেল। তাই, মটর সাইকেলের কথা দেব না দেব না করেও শেষ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছে। এখন Avro Spell Checker একবার বানান ঠিক করে নিলেই হল। Microsof Word থেকে সে পুরো লেখাটা কপি করতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো। ব্লগ-পোস্ট দেবার জন্য ব্লগ-পোস্ট না হয় দেয়া গেল। কিন্তু, এর বেশি কি কিছু করা যায় না? অনলাইনের কান্নাগুলোকে কি অফলাইনের চিৎকারে রূপ দেয়া যায় না?
সে আবার টাইপ করতে শুরু করল। ফেলানী হত্যার বিচারে প্রহসনমূলক রায়ের বিরুদ্ধে গণ-অবস্থান সোমবার। বিকেল তিনটায় ভারতীয় দূতাবাসের সামনে। চিৎকারটা না হয় সেখানেই দেয়া যাবে।
এবার পুরো লেখাটা কপি করতে গিয়ে আবার থমকে গেল। পোস্টটা লিখেছে, ভারতীয় পণ্য বর্জন নিয়ে। এ নিয়ে সবাইকে কি এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসা যায় না? আবার লিখতে শুরু করল, ফেলানীর আত্মহত্যাঃ সকল ইন্ডিয়ান পণ্য বর্জন এবং ফেলানি হত্যাকাণ্ডের রায় মানি না। প্রতিবাদে ভারতীয় সব টিভি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করা হউক।এই ইভেন্ট দু’টো দিয়ে যেন, ভারতীয় পণ্য বিরোধী সকলে এক প্লাটফর্মে আসতে পারে।
এবার পুরো লেখাটা ব্লগে পোস্ট করে দিল। হঠাৎ খেয়াল করল, তার খানিকটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। তার কোন নাম আছে বলে মনে হয় না। তবে, অনলাইনে মায়াকান্না না কেঁদে রাজপথে চিৎকার দিতে পারার অনুভূতির সাথে এর বেশ মিল আছে।

ইস্টিশন ব্লগ: http://istishon.com/node/4599

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক