নারীর উন্মুক্ত মুখ কিংবা পুরুষের পশ্চাদ্দেশের কথকতা...
প্রায় মাস খানেক আগের ঘটনা। এবারের HSC পরীক্ষার্থীদের একটা গ্রুপে এক ছেলে, “মেয়েদের পর্দার প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যান্য হ্যান ত্যান সিলিং ফ্যান” নিয়ে একটা জ্ঞানগর্ভ পোস্ট প্রসব করল। আমি সেখানে গিয়ে কমেন্ট ঝাড়লাম, “তাহারা মেয়েদের উন্মুক্ত মুখমণ্ডল দেখিয়া গেল গেল গেল বলিয়া লাফাইয়া ওঠে। কিন্তু, ছেলেদের উন্মুক্ত পশ্চাদ্দেশও কখনও তাহাদের ভাবান্তর ঘটায় না।” ব্যাস শুরু হয়ে গেল! চলল তর্কযুদ্ধ। এবং চিরাচরিতভাবেই তাহাদের শেষ কথা ছিল, “কোরআনে এখানে কী বলা আছে, তা বোঝার সামর্থ্য তোমার নাই। ভাল কোন আলেমের কাছ থেকে এসবের মানে জেনে এসে তারপর কথা বল।”
তবে সেদিনই ঠিক করে রেখেছিলাম, কোরআন বোঝার মত জ্ঞানগরিমা না থাকলে এতদসম্পর্কিত কথাগুলো নিয়ে একটা ব্লগপোস্ট লিখব। আমার মহিমান্বিত পিসির সুবাদে এতদিন লেখা হয়নি। আজকে আলসেমি ফেলে শুরু করেই দিলাম।
শুরুটা করা যাক, তাদের অতি প্রিয় একটা আয়াত দিয়ে।
“আর তোমরা বাড়িতে অবস্থান করবে, আর পূর্ববর্তী অজ্ঞানতার যুগের মত প্রদর্শন করবে না, আর নামাজ কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর, আর আল্লাহ ও তার রসূলের আজ্ঞা পালন কর। নিঃসন্দেহে আল্লাহ চান, হে গৃহবাসীনীগণ, তোমাদের পবিত্র করতে পবিত্রতার দ্বারা।” সূরা আহযাব : আয়াত তেত্রিশ (কোরআন – ৩৩:৩৩)
আমাদের আল্লামা তেতুলপুরী এবং তদসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আলেমদের অত্যন্ত প্রিয় একটা লাইন এটা। তবে যেহেতু আমি বেজায় ঘাড়ত্যাড়া পাবলিক। সুতরাং একটু ফ্ল্যাশব্যাক করলাম। তার আগের আয়াতে দেখা গেল:
“হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা অন্য কোন স্ত্রীলোকের মত নও; যদি তোমরা ধর্মভীরুতা অবলম্বন কর তবে কথাবার্তায় তোমরা কোমল হইয়ো না। পাছে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়, আর তোমরা বল উত্তম কথাবার্তা।” সূরা আহযাব : আয়াত বত্রিশ (কোরআন – ৩৩:৩২)
আরেকটু পেছনে গিয়ে ত্রিশ নং আয়াতে পাওয়া যায়,
“হে নবীর পত্নীগণ তোমাদের মধ্যে যদি কেউ স্পষ্ট অশালীনতা নিয়ে আসে, তার জন্য শাস্তিকে দ্বিগুণে বর্ধিত করা হবে। আর এটি আল্লাহর জন্য সহজ।” সূরা আহযাব : আয়াত ত্রিশ (কোরআন – ৩৩:৩০)
এখানে লক্ষ্য করার মত তিনটা বিষয় পাওয়া যায়।
- প্রথমত, আয়াতের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কথাগুলো বলা হয়েছে নবী-পত্নীদের উদ্দেশ্যে। এবং সত্যিই তাই। মুসলিম জাহানের সকল নারী অপেক্ষা নবী-পত্নীদের মর্যাদা অনন্য। তাই, তাদের বলা হয়েছে তাদের পবিত্র হয়ে থাকতে। এবং শালীনতা বজায় রাখতে। অনুরূপভাবে দেখা যায় যে, নবী বংশের কাউকে যাকাত দেয়া নিষিদ্ধ। একই ভাবে নবী-পত্নীদের দর্শনও সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ।
- দ্বিতীয়ত, “তবে কথাবার্তায় তোমরা কোমল হইয়ো না। পাছে যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে সে প্রলুব্ধ হয়” এই লাইনটা সব ধর্মব্যাবসায়ীদের মুখে ঝামা ঘসে দেয়ার মতই বলা চলে। নারী হয়ে জন্মেছে বলে কেউ সারা জীবন মাথা নিচু করে থাকবে আর রাস্তার দু’পাশ থেকে কেউ শীষ বাজাবে, টিটকিরি মারবে, অশ্লীল বাক্যবাণ ছুঁড়বে – ইসলাম মোটেও তা বলে না। ইসলাম সামনাসামনি দাড়িয়ে চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করতে বলে। বাজে মন্তব্য করলে, থাবড়া দিয়ে পাশের ড্রেনে ফেলে দিতে বলে।
- তৃতীয়ত, অনেকে বলতে পারেন, “নবী-পত্নীরা হচ্ছেন সকলের জন্য আদর্শ। সুতরাং তাদের জন্য যেটা বলা হয়েছে, সেটা অন্য সকল নারীরও মেনে চলা উচিত।” হ্যাঁ, ঠিক আছে। মানছি, নবী-পত্নীদের সকল মুসলিম নারীর অনুসরণ করা উচিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নবী-পত্নীরা কিন্তু এই আয়াত পড়ে গৃহাভ্যন্তরে বসে ছিলেন না। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এমন কি নবী-পত্নী আয়েশা, উষ্ট্রের যুদ্ধ তথা জঙ্গে জামাল এ নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। তাহলে, ঘটনা কী দাঁড়াল? ঘটনা দাঁড়াল এই যে, নবী-পত্নীরাও এই আয়াত শোনার পর নিজেদের ঘরের ভেতর আটকে রাখেন নি। তবে, নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে শুধু সেইসব পুরুষদের থেকে যাদের মেয়ে দেখলেই লালা ঝরে। যাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি।
তাদের আরেকটা প্রিয় আয়াত আছে এই সূরা আহযাবেই:
“হে প্রিয় নবী! তোমার স্ত্রীগণকে এবং কন্যাদের ও মুমিন লোকের স্ত্রীদের বল যে, তারা যেন বহির্বাস থেকে তাদের উপরে টেনে রাখে, এটিই বেশি ভাল যেন তাদের চেনা যায়, তাহলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ পরিত্রাণকারী ও অফুরন্ত ফলদাতা।” সূরা আহযাব : আয়াত ঊনষাট (কোরআন – ৩৩:৫৯)
অর্থাৎ, নারীদের পোশাকের ব্যাপারে শালীন হতে বলা হয়েছে। তবে তার পরের আয়াতেই বলা হয়েছে,
“যদি মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা, আর শহরে গুজব রটনাকারীরা না থামে তাহলে আমরা নিশ্চয়ই তোমাকে তাদের ওপর ক্ষমতা দেব। তখন তারা সেখানে তোমার প্রতিবেশী হয়ে থাকবে না। অল্পকাল ছাড়া অভিশপ্ত অবস্থায় তাদের যেখানেই পাওয়া যাবে, তাদের পাকড়াও করা হবে এবং হত্যা করা হবে হত্যার মত।” সূরা আহযাব : আয়াত ষাট-একষট্টি (কোরআন – ৩৩:৬০-৬১)
আমরা মেয়েদের শালীন পোশাক পরা (কিংবা বোরখার মধ্যে ভরে দেয়া) এর কথা বলতে খুব পছন্দ করি। তবে, উত্যক্তকারীদের তথা যাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি তাদের ‘হত্যা করার মত হত্যা’ করার ব্যাপারে বরাবরই নীরবতা পালন করি। কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!
আবার পোস্টের শিরোনামে ফিরে যাই। আমাদের দেশের মেয়েদের সাধারণ পোশাক কী? কৈশোর-যৌবনে সালোয়ার-কামিজই বেশি। আর খানিকটা বড় হলে শাড়ি। গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডির মত এলাকা বাদ দিলে দেশের প্রায় সব মেয়েই সালোয়ার-কামিজ বা শাড়িই পরে। যারা আমার এই পোস্টটা পড়ছেন, আশা করি তারা কেউই এগুলোকে অশালীন পোশাক বলবেন না। যারা অভ্যস্ত নন, তাদের কাছে মেয়েদের জিন্স-টিশার্ট-শার্ট পরাটা অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। তর্কের খাতিরে আবারও বলছি তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম এগুলো অশ্লীল পোশাক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশে ইভটিজিংয়ের জন্য যে ক’টা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সবই ঘটেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বহু আসে নি মিডিয়ার চোখেই। তাদের ক'জন জিন্স-টিশার্ট পরত?
আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার দেখা মতে যত মেয়ে আলেমদের ফতোয়া অনুসারে অশ্লীল পোশাক পরে, তার দশ থেকে বিশগুণ ছেলের প্যান্ট পশ্চাদ্দেশের মাঝ বরাবর থাকে। আমি এসব নিয়ে কোন আলেম ওলামাকে কখনও উচ্চবাচ্য করতে দেখি নি। কারণ কী? পর্দা কি শুধু মেয়েদের জন্যেই? ইসলাম কি তাই বলে?
“তুমি মুমিন পুরুষদের বল যে, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে” সূরা নূর : আয়াত ত্রিশ (কোরআন – ২৪:৩০)
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে ইসলামের হেফাজতকারীরা তাদের নিজেদের লজ্জাস্থানকে হেফাজতনা করে নারীদের লজ্জাস্থানের প্রতিই বেশি মনোযোগী হয়। সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যাধি।
“আর মুমিন নারীদের বল যে তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে, আর তাদের আঙ্গিক কর্তব্যাবলীর হেফাজত করে, আর তাদের অঙ্গশোভা যেন প্রদর্শন না করে শুধু তার মধ্যে যা প্রকাশ হয়ে থাকে তা ভিন্ন, আর যেন তারা তাদের মাথার কাপড় দিয়ে তাদের বুকের উপরটা ঢেকে রাখে, আর তারা যেন তাদের শোভা-সৌন্দর্য প্রদর্শন করে না শুধু তাদের স্বামীদের অথবা তাদের পিতাদের অথবা তাদের শ্বশুরদের অথবা তাদের পুত্রদের অথবা তাদের সৎপুত্রদের অথবা তাদের ভাইদের অথবা তাদের ভ্রাতুষ্পুত্রদের অথবা তাদের ভাগনেদের অথবা তাদের পরিচারিকাদের অথবা তাদের ডান হাত যাদের ধরে রেখেছে, অথবা পুরুষ চাকর-নকর যাদের কাম-লালসা নেই, অথবা ছেলেপিলেদের যাদের নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে জ্ঞানবোধ হয় নি, এমন লোকদের ভিন্ন, আর তাদের পা দিয়ে যেন তারা আঘাত না করে যাতে তাদের অলংকারের যা লুকিয়ে আছে তা জানানো যায়। আর হে মুমিনগণ! তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর দিকে ফেরো যেন তোমাদের সফলতা অর্জন হয়।” সূরা নূর : আয়াত একত্রিশ (কোরআন – ২৪:৩১)
অতএব ইসলামে আগে বলা হয়েছে পুরুষকে সংযত হতে। অতঃপর নারীদের ব্যাপারে নাক গলাতে বলা হয়েছে।
কিন্তু, আমরা নারীদের ব্যাপারে যতটা সরব পুরুষের ব্যাপারে কখনই ততটা হই না। কেন? অথচ কোরআনে বলা হয়েছে:
“নিশ্চয়ই মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারী, আনুগত্যশীল পুরুষ ও আনুগত্যশীলা নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদিনী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীলা নারী, বিনয় অবলম্বনকারী পুরুষ ও বিনয় অবলম্বনকারিনী নারী,খয়রাতকারী পুরুষ ও খয়রাতকারিনী নারী, রোজাদার পুরুষ ও রোজাদার নারী, “লজ্জাস্থানের হেফাযতকারী পুরুষ ও লজ্জাস্থানের হেফাযতকারিনী নারী”, অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকরকারী পুরুষ ও যিকরকারিনী নারী - তাদের সকলের জন্য আল্লাহ তায়ালা মাগফিরাত ও মহা-পুরস্কার প্রস্তুত করে রেখেছেন।” সূরা আহযাব : আয়াত পঁয়ত্রিশ (কোরআন – ৩৩:৩৫)
সবখানেই পুরুষ আর নারীর কথা একত্রে বলা হয়েছে। অথচ, আমরা কখনই বলি না পুরুষের কথা। যেটুকু নয় আমরা তার চেয়েও বেশি নারীদের ওপর আবরণ চাপিয়ে দিতে পছন্দ করি। কিন্তু, পুরুষকে যেটুকু বলা হয়েছে তাও পালন করতে বলি না। নারী যদি বোরকা না পরে স্রেফ মুখটাও দেখায় আমাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। কিন্তু, যখন কোন পুরুষ জিন্সের প্যান্ট পরে অর্ধেক পশ্চাদ্দেশ প্রদর্শন করে দিব্যি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, আমাদের ধর্মানুভূতি তখন মামার বাড়ি বেড়াতে যায়।
শেষ করি Karen Armstrong এর A History Of GOD বইয়ের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে:
“দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, খৃষ্টধর্মের মত এই ধর্মটিও পুরুষদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে, তারা এমন ভাবে বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা করে যা মুসলিম নারীদের পক্ষে নেতিবাচক। কোরআন মর্যাদার প্রতীক হিসেবে কেবল মুহাম্মদ (সঃ) এর স্ত্রীদের জন্যেই পর্দার পরামর্শ দিয়েছে, সবার জন্য নয়। অবশ্য সভ্য জগতে ইসলাম স্থান করে নেয়ার পর মুসলিমরা নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় অবনমিতকারী ওকুইমিনের রেওয়াজ গ্রহণ করে। তারা মহিলাদের অবগুণ্ঠনে আড়াল করার ও পার্সিয়া ও বাইযান্তিয়ামের হেরেমে আলাদা করে রাখার রীতি গ্রহণ করে। এসব জায়গায় এভাবে নারীদের অবস্থা প্রান্তিক হয়ে গিয়েছিল। আব্বাসিয় খেলাফতের (৭৫০ – ১২৫৮) সময় নাগাদ মুসলিম নারীদের অবস্থা ইহুদী ও ক্রিশ্চান সমাজে তাদের সগোত্রীয়দের মতই করুণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ মুসলিম নারীবাদীরা পুরুষদের কোরআনের আদি চেতনায় ফিরে যাবার আবেদন জানাচ্ছে।”
ইস্টিশন ব্লগ: http://istishon.com/node/6263
Comments
Post a Comment