'বাংলার শ্রেষ্ঠ প্রতিভা' বিষয়ক স্মৃতিকথা

মোটামুটি চৌদ্দটা বছর তার সাথে আমার পরিচয় ছিল দু’টো লাইন দিয়ে।
বল বীর
বল উন্নত মম শির।

কবিতার চেয়ে আড্ডাবাজিতেই বেশি আগ্রহ থাকায় আর সামনে এগোনো হয় নি। চট্টগ্রাম থেকে আব্বু ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় আসায়, ক্লাস নাইনে চলে এলাম ঢাকায়। কৈশোরের উচ্ছ্বলতার পাট চুকিয়ে খানিকটার ধীমান হতে শিখেছি। কীভাবে কীভাবে যেন কবিতা লেখার অভ্যাস হয়ে গেল(কারও প্রেমে পড়ি নাই কইলাম!) লিখতে গিয়ে ভাল মতই টের পাচ্ছিলাম, কবিতা না পড়ে লেখা যায় না। তখন আবার নতুন নতুন আস্তিকতায় ‘রিভার্ট’ করেছি। ধর্মানুভূতি(!) তখন তুঙ্গে। কাফের মুরতাদ(?) রবিঠাকুরের কবিতা পড়া আমার সাজে না। তাই নজরুলকেই আঁকড়ে ধরলাম।

এবং তার মাঝে যতই ডুবে গেলাম। অবাক হলাম ঠিক ততটাই। কত সহজে তাকে আমরা ‘মুসলিম জীবনচেতনার সাম্প্রদায়িক কবি’ বানিয়ে দিয়েছি। অথচ তিনিই লিখে গেছেন,
বাজে মঞ্জুল মঞ্জির রিনিকিঝিনি,
নির্ভরণে চলে রাধা বিনোদিনী

তিনিই বিয়ে করেছেন প্রমীলা দেবীকে। আবার তিনিই থুথু দিয়েছেন তাদের মুখে যারা করে জাতের নামে বজ্জাতি। তার সব কথাকে এক লাইনে চূর্ণ বিচূর্ণ করেছেন এই বলে:
তোরা সৃষ্টিকে তার ঘৃণা করে
স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে

কিংবা, মানুষ এনেছে গ্রন্থ; গ্রন্থ আনে নি মানুষ কোন।
পরিচিত হলাম তার সাহিত্য সম্ভারের মাঝে। ফিরে ফিরে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছে। ‘এমন একজন কবির পরে আর কি কিছু থাকে যোগ করার মত?’ উত্তরটা ভেবে পাই নি।
বরং মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখি গেছি তার খোদ স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা। অন্যায়ের কবলে পড়লে স্বয়ং ঈশ্বরকেও ছেড়ে না দেয়ার হুশিয়ারি।
আমি বিদ্রোহী ভৃগু; ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন
আমি স্রষ্টা-সূদন; শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন

নজরুলের মাঝ দিয়ে যতটাই এগিয়ে গেছি, অবাক হয়েছি ততটাই। মুগ্ধ-বিস্মিত হয়েছি তারও বেশি। ছোট্ট একটা মানবজনমে এত ঘটনা-দুর্ঘটনা-রটনা। বোধ হয় লালনের কথাটা সারাজীবনই তার মাথায় ছিল:
এমন মানবজনম আর কী হবে?
মন যা কর, ত্বরায় কর এই ভবে।।

তাই জন্মের পর পিতার মৃত্যু। পিঠে পরিবারের বোঝা। সেই বোঝা সইতে না পেরে লেটোর দলে পালিয়ে যাওয়া। আবার পড়াশোনার গণ্ডিতে ফিরে অনন্য-সাধারণ ফলাফল। তারপর আবার যুদ্ধের দামামা। ফিরে এসে অসি ফেলে মসি ধারণ। তারপর তো ইতিহাস।

সেই ইতিহাসের মাঝে আবার ঘূর্ণীঝড়। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ‘বাংলার শ্রেষ্ঠ প্রতিভা।’ আর ফেরা হল না।
যতটুকু করা যায়, ঠিক ততটাই করে গেছেন, তার ছোট্ট জীবনে। জীবন কি কখনও এর চেয়েও মহনীয় হতে পারে? বোধ হয় না। তাই তিনি উঠেছেন এই পৃথিবীর চেয়ে উচ্চ কোন উচ্চতায়:
আমি চির বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা; চির উন্নত শির


ইস্টিশন ব্লগ: http://istishon.com/node/2163

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক