এখানে পৃথিবী অন্ধকার

আমি এখন একটা বিশাল কড়ই গাছের নিচে বসে আছি। আর একটু সামনে এগিয়ে বসা উচিত ছিল। ধরা পড়ার সম্ভাবনা কমে যেত। কিন্তু, পারছি না। পা দুটো পুরোপুরি অসাড় হয়ে আছে। হৃদপিণ্ডটা হাপরের মত ওঠানামা করছে। হঠাৎ রাস্তা ধরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। এক মুহূর্তের জন্যে কেউ যেন আমার পায়ে ক্লোরো ইথেন স্প্রে করে দিল। সব ব্যথা ভুলে আমি আবার দৌড় দিলাম। কিন্তু, এগোতে পারলাম না। একটু পরেই নিজের পায়ের গোড়ালির সাথেই ধাক্কা লেগে পড়ে গেলাম। ওরা কি কিছু দেখতে পেয়েছে? এতো কিছু ভাবার সময় নেই। আমাকে এখন পালিয়ে থাকার ভাবনাটাই ভাবতে হবে। আপাতত বাঁচার পথ হিসেবে পাশের ডোবাটা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে রাস্তার ঢাল দিয়ে গড়িয়ে দিলাম। গড়াতে গিয়ে হঠাৎ প্রচণ্ড শক্ত কিছুর সাথে মাথায় আঘাত লাগল। প্রথমে খানিকটা রক্ত গড়িয়ে চোখের সামনে পড়ায় শুধু লাল রংটা দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু পরে তাও পেলাম না। পুরো পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এলো। 

*** *** ***

দৃশ্যগুলো বেশ ঝাপসা। ঠিকমত কিছু বোঝা যাচ্ছে না। শুধু সুপুরি গাছটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। প্রচণ্ড বাতাসে নব্বই বছরের বৃদ্ধের মত নুয়ে পড়ছে। কিন্তু ভাঙ্গছে না। হঠাৎ আম গাছটার একটা ডাল ভেঙ্গে পড়ল সুপুরি গাছটার ওপর। প্রচণ্ড আঘাতে সেটা আরও বেশি নুয়ে পড়ল। কিন্তু ভাঙ্গল না এবারও। বরং আঘাতের প্রচণ্ডতাকে ঝেড়ে ফেলে সেটা আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড়াল সগৌরবে। একটা ছোট্ট লিচু গাছ দেখতে পাচ্ছি। ঝড় যেহেতু বড়দের মাথার ওপর দিয়েই যায়, তাই লিচু গাছটাকে নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। 

দৃশ্যপটে এই প্রথম একজন মানুষের দেখা পেলাম। একজন মহিলা। তার মুখটা ঘামে নাকি চোখের পানিতে ভিজে আছে ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না। যেটাই হোক, তার সেই ভেজা মুখের ওপর ঝড়ে ধুলোর আস্তরণ জমে আছে বলে প্রথমবার দেখে সেটাকে মানুষের মুখ বলে মনে হয় না। একটা ধারণা পেতে দ্বিতীয়বার ভাল করে তাকাতে হয়। মুখে জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ নিয়ে তাকে বেশ বিরক্ত মনে হল। 

তার পাশে একটা অষ্টাদশী তরুণী এলো-চুলে বসে আছে। এই প্রথমবার আমি দৃশ্যপটের কাউকে চিনতে পারলাম। তরুণীটি আমি। 

ধীরে ধীরে মঞ্চে মানুষের সমাগম বাড়ছে। নতুন যার আগমন ঘটল তিনি একজন চল্লিশোর্ধ প্রৌড়। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার আগমন ঘটল। নতুন করে কয়েকটা নিউরন জোড়া লাগায় মনে পড়ল তিনি আমার কাকা। আমার অতি প্রিয় ছোট কাকা। প্রায় সাথে সাথে আরও একটা তথ্য মনে পড়ল। একটু আগে দেখা মহিলাটি আমার মা। ঠিক করে বলতে হলে বলতে হয় আমার ছোট মা। কিন্তু, আমি তাকে কোনদিনই ছোটো মা বলে ডাকি নি। হয়তো তিনি তাতে মনে কষ্ট পাবেন ভেবে, ডেকেছি মা বলেই। কিন্তু, এখন তাকে ছোট মা ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে। কারণ তাতে মা শব্দটা মিশে আছে। 

আমার সামনে দিয়ে একটা ছেলে একটু পরপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে আসা যাওয়া করছে। দেখে মনে হচ্ছে, কাজ করার চেয়ে সে যে কাজ করছে, এটা আমাকে দেখাতেই তার আগ্রহ বেশি। 

আর একটু সামনে একটা কফিন। সেখানে একটা মানুষ শুয়ে আছে। এই পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আপন মানুষটি। আমার বাবা। যে দুটি চোখ দিয়ে আমি পুরো পৃথিবীকে দেখতাম, তা বন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। 

এতক্ষণের যুদ্ধের পর ঝড়ের কাছে পরাজিত হয়ে সুপুরি গাছটা ভেঙ্গে পড়ল চড়চড় করে। জীবন নামের যুদ্ধটার শেষে কি সবাইকেই এভাবে ভেঙ্গে পড়তে হয়?

সাইন্যাপ্সগুলো আবার বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে। চেতনা মিলিয়ে যাচ্ছে আধারে। 

*** *** ***

এই অন্ধকারে আমাকে এখন দেখলে যে কেউই মনে করতে পারে গ্রামের কোন শাঁকচুন্নির অতি সাধের শ্যাওড়া গাছটা কেউ কেটে ফেলেছে বলে, সে রাগ করে মফস্বলে চলে এসেছে। ভাবাটা অসম্ভব কিছু না। অন্তত আমি নিজে এখন নিজের যে চেহারাটা কল্পনা করছি তাতে আমাকে এমন কিছুই মনে হচ্ছে। এখন পালিয়ে থাকতে হলে আমার মূল কাজ হচ্ছে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করা। তবে এলোমেলো চুল, কাদায় ভরা শরীর এবং কাদা রক্তে মাখামাখি হয়ে পোড়া মাটির মত রং ধারণ করা মুখটা যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণের দায়িত্বটা পালন করবে কাজে কোন ফাঁকি না দিয়েই। তাই এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে কারও চোখের সামনেই না পড়া। 

কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে আমাকে একই সাথে আরও একটা কাজ করতে হবে। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে যাওয়া। এখান থেকে সরে যাওয়া মানে, কমপক্ষে এই জেলা থেকে সরে যাওয়া। আর এই দুটো কাজ একসাথে করা অসম্ভবের কাছাকাছি। কপালে কী আছে ঠিক জানা নেই। কিন্তু, কপালের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে কী হবে সেটা জানা আছে খুব ভাল ভাবেই। তাই রাস্তার পাশের ঢালু জায়গাটা ধরে সামনে এগোতে শুরু করলাম।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা এক নাগাড়ে হাটার পর একটা টঙের দোকান চোখে পড়ল। সাথেই সাথেই এতক্ষণ ধরে ঘুমিয়ে থাকা খিদেটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু, প্রথমত, এই অবস্থায় কিছু কিনতে যাওয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, আমার কাছে কোন টাকাও নেই। কিন্তু, ক্ষুধা কোন যুক্তি কোন কালে মেনেছে বলে আজ অবধি শুনি নি। আমাকেও এখন খেতে হবে। যেভাবেই হোক কিছু খেতে হবে। একটা উপায়ই মাথায় এলো খাবার জোগাড় করার জন্য। 

যেমন আছি ঠিক তেমন ভাবেই উপস্থিত হলাম দোকানের সামনে। চারটা বছর একটা অন্ধকার কুঠুরিতে বদ্ধ থাকায় যে টুকু অস্বাভাবিকতা জন্মেছিল আমার মধ্যে, তার সবটুকু একসাথে জড় করে দোকানদারকে বললাম, “খাবার দে। খিদা লাগছে।” 

পদ্ধতিটা কাজে দিল। দোকানদার বিরক্ত গলায় বলল, “মাঝ রাইতে পাগলির জ্বালা।” কিন্তু, তার সাথেই একটা বনরুটি বের করে আমার দিকে ছুড়ে দিল। প্রচণ্ড ক্লান্ত থাকায় ধরতে পারলাম না। নিচে পড়ে গেল। সেটা কোন বিষয় না। সাথে সাথে রুটিটা উঠিয়ে শত বছরের অভুক্তের মত খেতে শুরু করলাম। ধুলো ঝাড়ার সময়টুকুও নষ্ট করলাম না। রুটিটা শেষ করতেই পাশ থেকে কে যেন বলল, “মনে হয় তো কয়েকদিন ধইরা কিছু খায় নাই। দাও, ওরে আরেকখান বন দাও।”
দোকানদার বিরক্ত গলায় বলল, “পাগলরে এত প্রশ্রয় দিয়া ঠিক না।”
সাথে সাথে আমি মোটামুটি চিৎকার করে উঠলাম, “ওই হালার পুত! তোরে দিতে কইছে দিবি। এত কথা কস ক্যান?”

বলেই সমর্থনের আসায় লোকটার দিকে তাকালাম। বয়স হলেও বেশ শক্ত সমর্থ চেহারা। পুরু গোঁফে বেশ মানিয়েছে। তবে, সম্ভবত আমার একটু আগের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে খানিকটা বিব্রত। 

সে কিছু বলার আগেই দোকানদার বলল, “দেখছেন নি কারবারডা? কইছিলাম না প্রশ্রয় দিয়া ঠিক না! এইবার কথা ফলল তো?”
লোকটা বলল, “আরে দ্যাও, দ্যাও। দুই দিন না খাইয়া থাকলে তুমি এর তিন গুন চিল্লাইতা।” 

দোকানদার বিরক্তমুখে বের করে দিল। 

পরপর ছয়টা প্রমাণ আকৃতির বনরুটি আর চার গ্লাস পানি খেয়ে আমি থামলাম। লোকটাকে একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। দেব না। পাগলরা কাউকে ধন্যবাদ দেয় না। আপাতত যেটুকু বুঝতে পারছি, আমাকে টিকে থাকতে হলে পাগল হয়েই টিকে থাকতে হবে। দ্রুত রাস্তা থেকে সরে গেলাম। 

হঠাৎ চোখে পড়ল, রাস্তার পাশে একটা ট্রাক দাড় করিয়ে রাখা। ড্রাইভার কে হবে সেটা অনুমান করে নেয়া যায়। এখান থেকে পালিয়ে যাবার এর চেয়ে ভাল অনুষঙ্গ আর কিছু হতে পারে না। ট্রাকে উঠে ত্রিপলের ওপর শুয়ে পড়লাম। ভাগ্য যদি ভাল হয়, তাহলে লোকটা রওনা দেয়ার আগে দেখতে আসবে না। ভাগ্যটা ভাল না খারাপ সেটা পরীক্ষা করতে পারলাম না। তার আগেই রাজ্যের অবসন্নতা দু’চোখে ভর করল। 

*** *** ***

নিকষ আধার। নিজের হাতের তালুও দেখা যায় না এতোটাই। প্রচণ্ড গরম। বাতাস হালকা হয়ে আগুনের হলকা হয়ে আছে। সেই বাতাসে একজন মানুষের নি:শ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। আমার ছোট কাকা। আমার অতি প্রিয় ছোট কাকা। হঠাৎ করে আজকাল কেন যেন এই অতি পরিচিত শব্দটার সাথে আমি পিশাচের নি:শ্বাসে বড় বেশি মিল খুঁজে পাচ্ছি। ছোট কাকার পাশ থেকে হঠাৎ একটা টর্চ জ্বলে উঠল। আমার মনে হল আমার দুচোখে কেউ যেন গরম লোহার শিক ঢুকিয়ে দিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণায় একটা চিৎকার দিতে চাইলাম। কিন্তু, গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হল না। কতদিন ধরে এ দুটো ঠোট কোন কথা বলে না কে জানে?

আলোটা চোখে খানিকটা সয়ে আশতেই দেখলাম টর্চ ধরে আছে রাহুল। প্রচণ্ড ঘৃণায় একদলা থুথু ফেললাম মেঝেতে। থুথুটাকেও এখন ঘৃণা হচ্ছে। থুথুর শব্দে তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হল কিনা বুঝতে পারলাম না। হবার কথা না। ওদের, ওদের সবাইকে আমি কতটা ঘৃণা করি সেটা ওরাও খুব ভাল করেই জানে। 

হঠাৎ বাইরে বড় কাকার চেঁচামেচি শোনা গেল। আমি আরও একবার আশায় বুক বাধলাম। কিন্তু, পরক্ষণেই সেটা মিলিয়ে গেল। আমার ছোট মা যার বর্তমান পরিচয় আমার ছোট কাকই, তিনি বরাবরের মতই আমার বৃদ্ধ বড় কাকাকে বুঝিয়ে দিলেন, “স্মৃতি তার বাবার শোকে পাগল হয়ে গেছে। এখন কাউকে দেখলেই তেড়ে মারতে আসে। বাইরের কাউকে জানালে লজ্জার ব্যাপার। তাই ঘরেই চিকিৎসা হচ্ছে। ভাল হয়ে যাবে অতি-দ্রুত।” তবে, সেই অতি-দ্রুত ঘটতে চলা ঘটনাটা কবে ঘটবে কেউ জানে না। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, বড় কাকা চুপ হয়ে যাওয়ায় আমি আশাহত হলাম না। বোধ হয় বারবার আশাগুলো ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়ায় আর ঠিকভাবে গড়েই উঠতে পারে নি। কিংবা, এটা এমন কোন আশা, যেটা ভেঙ্গে যাওয়ায় কোন বেদনা নেই। 

আবার বড় কাকার হইচই শোনা গেল। বড় কাকা ফিসফিস করে বললেন, ‘রাহুল, এবার কি তোর বড় কাকা এসেই ছাড়বে না’কি? শিউলি সামলাতে পারবে তো?’
-এ তো কিছু না ভেবে ইনজেকশনটা পুশ করে দাও। তারপর, এলেই কি আর না এলেই কী?

ছোট কাকা কথা বাড়ালেন না। ইনজেকশনটা পুশ করে দিলেন। সাথে সাথে মনে হল, আমার সারা শরীরে কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমার সারা শরীর পুড়ে যেতে চাইছে। গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিতে চাইলাম। শুধু একটা অস্পষ্ট গোঙ্গানি শোনা গেল। আমি পাগলের মত হাত পা ছুড়তে শুরু করেছি। হঠাৎ কেন যেন রাহুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমার গায়ে পশুর মত শক্তি এসে ভর করেছে। রাহুলের মত শক্তসমর্থ ছেলেও আমাকে ছাড়াতে পারছে না। শেষে না পেরে, আমার পেটে একটা লাথি মারল। আমি ছিটকে দুরে সরে গেলাম। ততক্ষণে, ছোট কাকা আর রাহুল বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি অসহ্য যন্ত্রণায় হাত পা ছুড়তে লাগলাম। সেই সাথে চলল, পশুর মত গোঙ্গানি। কিংবা, পশুর চেয়েও অসহায় আর্তনাদ। মানুষ কখনও কখনও জঙ্গলের পশুর থেকেও অসহায়। কিংবা, সব সময়েই সে অসহায়।

একটু পরে বড় কাকা ভেতরে ঢুকলেন। শান্ত, সৌম্য চেহারা। লম্বা সাদা পাঞ্জাবি, ধবধবে সাদা দাড়ি আর চুল। দেখে কোন দরবেশ বলে ভুল হয়। আমার অতি প্রিয় এই মানুষটাকে দেখেই আমি হায়েনার মত তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বড় কাকা সরে যাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু, বয়সের কারণে পারলেন না। হঠাৎ, খেয়াল করলাম, বড় কাকা, রাহুল আর আমার ছোট মা কিংবা বর্তমান ছোট কাকই বাইরে দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে, যথার্থ সময়ের। সেদিকে মনোযোগ দিতে পারলাম না। বড় কাকার মুখে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কিল ঘুষি মারতে শুরু করলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল পাশে একটা ক্রিকেট ব্যাট রাখা। লাফিয়ে গিয়ে ওটাকে ধরলাম। তারপর শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে সেটা দিয়ে বড় কাকার মাথায় বাড়ি দিলাম। বাইরে সবাই সম্ভবত এটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। সাথে সাথে রাহুল ভেতরে ঢুকে আমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ঘরের এক কোণায় ফেলে রাখল। আমি অস্পষ্টভাবে গোঙাতে শুরু করলাম। ছোট কাকা বড় কাকার মৃতদেহটাকে টেনে বাইরে নিয়ে গিয়ে দরজাটা আঁটকে দিলেন।

*** *** ***

ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দের কারণে রাতের নিস্তব্ধতাটাকে ঠিকভাবে অনুভব করতে পারছি না। হঠাৎ, কেন যেন আমার ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে ইচ্ছে করছে খুব। চারটে বছর আমি সহস্র নির্ঘুম রাত পার করেছি ঝি ঝি পোকার ডাক শুনে। আজকে সেটা শুনতে না পেরে অস্বস্তি হচ্ছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মাথাটা চেপে ধরলাম। আবার ট্রাকের দুলুনির তালে তালে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। ঘুম ঠিকমত এলো না। খানিকটা তন্দ্রা এলো। চোখের সামনে আবারও চার বছর আগের কোন এক দুঃস্বপ্নের রাত। 

*** *** ***

আমি ঘরের কোন এক কোণায় জবুথবু হয়ে বসে আছি। দরজাটা আস্তে করে খুলে গেল। এত রাতে কে এসেছে খুব ভাল করেই জানি। রাতের বেলা আমার কাছে কোন প্রয়োজন আছে শুধু একজনেরই। রাহুল। কেন এসেছে তাও জানি। রাতের বেলা আমার কাছে তার কী প্রয়োজন তাও। আমার শরীরটা। যতদিন ধরে এই অন্ধকার কারাগারে আছি, তার নিত্য কর্মযজ্ঞের অংশ এটা। প্রথম কয়েকদিন অনেক চেষ্টা করেছি, নিজেকে রক্ষার। এখন আর করি না। মেনে নিয়েছি। কে যেন বলেছিল,”ধর্ষণকে ঠেকানোর কোন উপায় না থাকলে, সেটাকে উপভোগ করা উচিত।” আমি এখন এই পিশাচটার সাথে প্রতি রাতে আদিম প্রবৃত্তি উপভোগের চেষ্টা করি। পারি কি’না কে জানে? এই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একটা পিশাচ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ধীর পায়ে। পিশাচটা আমার রক্ত পান করবে। ছিবড়ে খাবে আমার দেহটাকে। আমি অপেক্ষা করছি, আমার রক্তপানের মুহূর্তের।

*** *** ***

সূর্যটাকে ঠিক কতদিন পরে চোখে পড়ল জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, বিভীষিকার রাতগুলো আমার চোখ দু’টোকে করে দিয়েছে বাদুড়ের মতই। এখন আর সূর্যালোক সহ্য হয় না। তাই বিশাল আম গাছটাকে পেরিয়ে যখন সূর্যটা প্রথমবার আমার চোখের ওপর উঁকি দিল, খানিকটা যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙ্গে গেল তখনই।

পাশে কোথাও পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। 

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। মাথাটা চেপে ধরতেই বুঝলাম, কেউ সেটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। একই সাথে বুঝলাম আনাড়ি হাতের ব্যান্ডেজ। ট্রাকের ওপর পড়ে রইলাম সেভাবেই। একটু পর কেউ বলল, ‘মা’র ঘুম ভাঙ্গছে?’ কাল রাতের সেই লোকটা সামনে এসে দাঁড়াল। ঘাড় কাত করে সম্মতির ভঙ্গি করলাম। অতি কষ্টে।
-আইচ্ছা। তাইলে ভেতরে আইসা শুইয়া থাক।

ওঠার চেষ্টা করতেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মাথা চেপে ধরে বসে পড়লাম।

-যন্ত্রণা কি বেশি?

ঘাড় কাত করে সম্মতি নিলাম।

সাথে সাথে লোকটা আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। সমগ্র মুখটা জুড়ে অনেকক্ষণ জুড়ে লোভ খুঁজে ফিরলাম। একটা পিশাচের ছবি খুঁজে ফিরলাম। পেলাম না। কিন্তু, আমি জানি তার মাঝেও পিশাচ বাস করে। এই পৃথিবীতে বাস করা প্রতিটা মানুষই এক একটা পিশাচ। এবং প্রতিটা পুরুষেরই মূল লক্ষ্য থাকে একটাই। কোন নারীর দেহ। কোন ব্যতিক্রম নেই। একটাও ব্যতিক্রম নেই তাতে। রাহুল এত দিন এই শরীরটাকে নিয়ে খেলেছে। দুমড়ে মুচড়ে একাকার করেছে। এবার করবে এই লোকটা। আমার কিছুই করার নেই। কিচ্ছু না। আমার জন্মই হয়েছে বোধ হয় অন্যের লালসা মেটাতে। তবে একটা কাজ আমি নিশ্চয় করতে পারি। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুরটা তৃপ্তির সাথে আমি কাউকেই তুলতে দিই নি। একেও দেব না। যতদিন এখানে থাকতে হয় আমি সব মেনে নেব। কিন্তু, ফেরার সময় সব হিসেব চুকিয়েই ফিরব। ঠিক করেই রাখলাম।

লোকটা আমাকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। আবারও মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একগুচ্ছ নিঃস্পৃহতা ছাড়া কিছু পেলাম না।


এখানে আমার তৃতীয় দিন চলছে। মাঝের দু’দিন লোকটা ছিল না। আর একটা চালান নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিল। আমার জন্য মুড়ি, চানাচুর, বিস্কুট আর পানি রেখে গিয়েছিল। সে সব খেয়েই থেকেছি। আজকে আবার এলো। সে এখন আমার সামনে বসে আছে। কিছু বলছে না। চুকচুক করে চা খাচ্ছে। চা’টা তার বেশ পছন্দ হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। এমন হবার কথা না। চা’টার তার নিজের তৈরি এবং ধারণা করা যায়, সে প্রতিদিনই এই চা খায়। মানুষ যে খাবারটা প্রতিদিন খায়, সেটা তার কখনই ভাল লাগে না। এক্ষেত্রে তা হচ্ছে না।

চা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি এইখানে আইসা পড়লা কেমনে?’

কোন উত্তর দিলাম না। একটা তীব্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

এমন প্রতিক্রিয়া হয়তো সে আশা করে নি। কিছু বলল না। চুপ থাকল।

তার মুখভঙ্গিটা দেখে কিছু একটা অনুভব করলাম। ঠিক কী বলতে পারব না। হঠাৎ ঠিক করলাম, তাকে বলব। সবকিছুই বলব। লুকিয়েও তো কোন লাভ নেই। না কোন লাভ আছে বলে। চিত্রনাট্য অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। আমি সুস্থ হওয়া অবধি তার এখানে থাকব। তার বিনিময়ে সে আমার দেহটা ভোগ করবে। স্বেচ্ছায় দিলে স্বেচ্ছায়। না দিলে জোর করে। এখনও শুরু করে নি। কিন্তু, করবে যে কোন সময়েই। জানি। খুব ভাল করেই জানি। তার পরের অংশও লিখে ফেলেছি। প্রতিদান স্বরূপ তার প্রাণপাখিটাকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দিয়ে আবার অজানার পথে রওনা।

তাকে বললাম, আমার বাবার মৃত্যুর কথা। সৎ মায়ের ছোট কাকা বিয়ে করার কথা। বাবার সম্পত্তির জন্য আমাকে পাগল সাজিয়ে নাটক করানোর কথা। আমাকে দিয়েই আমার বড় কাকাকে খুন করানোর কথা। আমার শরীরটাকে প্রতি রাতে রাহুলের জন্য উৎসর্গ করার কথা।

তার চোখ দু’টো বিস্ফোরিত হয়ে উঠল। এতক্ষণ সুন্দরভাবে চেনা এই পাগলীটাকে এমনভাবে বদলে যেতে দেখে সে নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। এই সাদামাটা চেহারার ছেড়া, ময়লা পোশাকের মেয়েটার ওপর দিয়ে এতটা ঝড় বয়ে গেছে, সে হয়তো কল্পনাও করতে পারে নি। শুকনো গলায় বলল, “তারপর?”

বললাম, তারপর একদিন ঠিক করে ফেললাম, আমাকে এই নরক থেকে মুক্তি পেতে হবে। যেভাবেই হোক। এখানে বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মাঝে কোন পার্থক্য নেই।

*** *** ***

সেদিন রাতে রাহুলের যখন আমার কাছে আসার সময় হল, আমি গিয়ে দরজার পাশে দাড়িয়ে রইলাম। এক নাগাড়ে। প্রতি মুহূর্তে প্রচণ্ড একটা ভয় আর তার চেয়ে বড় শঙ্কা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। মনে হচ্ছিল এই এখনই বুঝি, আমি ধরা পড়ে যাব। এই এখনই বুঝি, ছোট কাকা আমার গায়ে ইনজেকশন পুশ করবে। সারা শরীর পুড়ে যাবে অসহ্য যন্ত্রণায়। প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা সেভাবেই বসে থাকলাম। তারপর রাহুল এলো।

দরজা খুলতেই আমি দরজার আড়ালে পড়ে গেলাম। রাহুল টর্চ জ্বালল। টর্চের আলো হাতড়ে ফিরল, ঘরের এ কোণা থেকে ও কোণা। কোথাও আমি নেই। রাহুল ভীত গলায় ডাকল, “স্মৃতি”।

আমি পেছন থেকে ফিসফিস করে বললাম, “আমি এখানে”।

রাহুল হতভম্ব হয়ে পেছনে ফিরতেই আমি ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওকে আঘাত করার কোন চেষ্টা করলাম না। স্রেফ ওর চোখ দু’টোর মধ্যে দু’টো আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিলাম। রাহুল অমানুষের মত চিৎকার করে উঠল। সেই চিৎকার শুনে ছোট কাকা দৌড়ে এলো। আগে থেকেই আবার দরজার পেছনে লুকিয়ে গেলাম। ছোট কাকা ঘরে ঢুকতেই, রাহুলের টর্চটা দিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করলাম। ছোট কাকা মাথা চেপে পড়ে গেলেন। মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। পেছন পেছন এলো ছোট কাকী। তাকে কিছু বললাম না। স্রেফ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একটা মুখভঙ্গি করতেই ছোট কাকী লাফ দিয়ে দশ হাত পেছনে সরে গেল। পড়ে গিয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্থ রোগীর মত কাঁপতে লাগল। আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। মুক্ত বাতাসের নিঃশ্বাস।

কথা শেষ করে তার দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম, তার চোখ থেকে জল পড়ছে। স্বচ্ছ নোনা জল। বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। আমি এতদিন মানুষ বলতে যাকে চিনে এসেছি, তার সাথে এই আচরণ যায় না। আমি স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম।

লোকটা আবেগ মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলল, ‘মা, তোর মইধ্যে এত্ত কষ্ট? এত কষ্ট বুকের মধ্যে কেমনে যায়গা দিস?’

আমি কিছু বললাম না। শুধু স্তব্ধ চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মধ্যে এক ঝড় বয়ে চলছে। এতদিন যে ঝড় পার করে এসেছি, তার চেয়ে এই ঝড় কিছুমাত্র কম না। আমার এতদিনের চেনা পৃথিবীর মাঝে হঠাৎ করে বাইরের কেউ উপস্থিত হয়েছে। আমি তাকে চেনার প্রচণ্ড চেষ্টা করছি। চিনতে পারছি না। সত্যি বলতে বিশ্বাস করতে পারছি না, মানুষ পিশাচের চেয়ে উন্নত কিছু হতে পারে। সে অন্যের দুঃখে কাঁদতে পারে। তার সুখে হাসতে পারে। তার মাঝে মানবিকতা আছে। এ কি সত্যি! চিন্তা করে কুলোতে পারলাম না।

লোকটাই আবার বলল, ‘তোরে আর কিছু বলতে হবে না। তুই এইবার ঘুমা।’ বলেই আমাকে টেনে তার কোলের ওপর শুইয়ে দিল। আমার মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমার পরি ঘুমায়। আমার পাখি ঘুমায়।’

আমার হঠাৎ কেন যেন মনে হল, আমার বাবা মারা যায় নি। আমি এখন আবার বাবার কোলে শুয়ে আছি।

Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক