গল্প লেখার গল্প

“আমি বারান্দা দিয়ে সামনের পাহাড়টা দেখছি। এক কথায় অপূর্ব লাগছে। একটা ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু তুলব না। কারণ আমি খুব ভাল করেই জানি, দুরে ঠায় দাড়িয়ে থাকা সবুজ পাহাড়টাকে দুরে থেকে দেখতে যতটা ভাল লাগে, তাকে ফ্রেমে বন্দি করে কাছে নিয়ে এলে লাগে ঠিক ততটাই অসুন্দর। ঠিক জীবনের মত।”

এ টুকু লিখেই কালি আটকে গেল। না কালি শেষ হয়ে যায় নি। আমি নিজেই আটকে গেছি। আর কোন শব্দ মাথায় আসছে না। রৌদ্র পাশ থেকে বলল, 'তুই এখনও লিখে যাচ্ছিস?” একটু থেমে আবার বলল, “যেতে পারছিস?”

“আমি লেখা বন্ধ করে রাখলে মৌমিতা সুস্থ হয়ে যাবে না।” নিঃস্পৃহ গলায় উত্তর দিলাম। রৌদ্র সম্ভবত ঝাঁঝাল কোন উত্তর দিতে চেয়েছিল। দিল না। ও নিজেও বোধ হয় কোন শব্দ খুঁজে পায়নি। এই ছোট্ট করিডোরটায় আজকে শব্দেরা বড় বেশি দুর্লভ হয়ে উঠেছে। ওদের ফিরিয়ে আনতে খুব ইচ্ছে করছে। আনতে পারছি না। মানুষ কতটা অসহায় জীব সেটা গল্পে বহুবার লিখেছি। সত্যিকার অর্থে সেটা কী, তা বুঝতে পারছি জীবনে প্রথমবার। স্রষ্টা তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে সৃষ্টি করেছেন সবচেয়ে অসহায় করে।
রৌদ্র পাশ থেকে ঝাঁঝাল গলায় বলল, “থেমে আছিস কেন? তুই গল্প লিখ। তুই গল্প লেখা বন্ধ রাখলে তো আর মৌমিতা বেঁচে যাবে না। দেখ, ওকে গল্পেই বাঁচিয়ে দিতে পারিস কিনা?”

কথাগুলো গিয়ে ঠিক বুকের মাঝখানটায় আঘাত করল। ধুর! এসব লাইন মাথায় কোত্থেকে আসে? ফালতু একটা লাইন। গল্পে লিখলে এই একটা লাইনই পুরো গল্পকে ধরা খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট। একেবারে বস্তাপচা শোনায়। কিন্তু, আজ এটাই, এই বস্তাপচা লাইনটাই বড় বেশি সত্যি। 

হৃদপিণ্ড দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকা রক্তগুলোকে বললাম, কষ্টগুলোকে মুছে দিতে। ওরা নির্দয় ভাবে অস্বীকৃতি জানাল জীবাণুর সাথে যুদ্ধের খোঁড়া অজুহাতে। আজকাল কেন যেন মনে হয়, আমার শ্বেত রক্তকণিকারা এখন অলস ঘুমোয়। আমি বেঁচে আছি শয়তানের অনুচর জীবাণুদের দয়ায়। ঠিক আমার জীবন যেমন।

আমার জীবন-যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে বহু আগেই। আমি সেখানে পরাজিত নিদারুণভাবেই। আমরা সেখানে পরাজিত বহু আগেই। 

রৌদ্রের মুখের দিকে তাকালাম। পরাজিত শব্দটা জ্বলজ্বল করছে। ঠিক চার বছর আগে এই মুখটা কেমন ছিল মনে করার চেষ্টা করলাম। কতটা সুদর্শন ছিল ও? যে মুখটা দেখে মৌমিতা ভুলে গিয়েছিল, দুজনের মাঝে থাকা ধর্মের ব্যবধানের পাহাড়। যে মুখটা দেখে মৌমিতা দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস না করে আমার হাত ধরে চলে এসেছিল রৌদ্রের হাত ধরবে বলে। সে দিনটা মনে করার চেষ্টা করলাম।

প্লাটফর্মে টিকেট হাতে রৌদ্র দাড়িয়ে আছে। তার মুখে রাজ্যের উৎকণ্ঠা! আমি মৌমিতাকে নিয়ে ঠিকমত আসতে পারব তো? কিংবা মৌমিতা যদি শেষ মুহূর্তে মাত্র বছর খানেকের পরিচয়ের একটা ছেলের জন্যে নিজের বাবা মা দিদিকে ফেলে আসতে রাজি না হয়? 

সে সব উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা সব এক লহমায় ধুয়ে মুছে গেল। আমি অশ্বমেধ যজ্ঞ বিজয়ী বীরের মত রৌদ্রের হাতে মৌমিতাকে তুলে দিয়ে ট্রেনের ভেতর ঢুকলাম। সুবর্ণ এক্সপ্রেসের শ্বেতশুভ্র একটা বগিতে সুবর্ণা এক কন্যা সুবর্ণ অশ্রু ফেলছে। আমি নীরবে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “প্রিয়তা, আমি এসে গেছি।” মুহূর্তেই তার মুখে জমে থাকা সবটুকু কালো মেঘ সরে গিয়ে জ্যৈষ্ঠের সূর্যের মত ঝলমল করে উঠল। কন্যা পরম আবেগে আমার বুকে মাথা রাখল। 

হঠাৎ মৌমিতা এসে বলল, “এহেম এহেম! আমরা কি সামনের সিট দুটোয় বসতে পারি?” কেউ কোন উত্তর দিলাম না। দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম আরও আবেগে। রৌদ্র বলল, “মি: বৈশাখ এটা কিন্তু পাবলিক প্লেস।” কানে নিলাম না। 

হঠাৎ ভাবনায় ছন্দপতন হল নার্সের কথায়, “আরও দুব্যাগ রক্ত আধ ঘণ্টার মধ্যে রেডি রাখবেন।” রৌদ্র বেরিয়ে গেল। আমি আবার গল্প লিখতে শুরু করলাম। মৌমিতাকে আমার বাঁচাতেই হবে। হোক মিথ্যে! আজ সত্যের চেয়ে মিথ্যেই বেশি আপন। লিখতে শুরু করলাম, “জীবনটাকে আমিও অনেক সুন্দর ভাবতাম। আমার কাছে সে ছিল শুধু সিগারেটের ধোয়া আর এক নারীর রূপমুগ্ধতাকে ঘিরে। কিন্তু জীবন নামের সবুজ পাহাড়ের আঙ্গিনায় পৌছতেই সবার আগে চোখে পড়ে নিচের বস্তিগুলোকে। জীবন এখানে আশাহীন। সবুজ সুন্দর পাহাড়ই তাদের আচ্ছাদিত করে মৃত্যুদূত হয়ে...”

==========================================================

প্রিয়তা এসে পাশে বসল। খানিকক্ষণ কিছু বলল না। একটু পরে কণ্ঠে একরাশ ঘৃণা জমিয়ে বলল, “তুমি কি মানুষ? নাকি অন্য কিছু?”
“বোধ হয় পিশাচ শ্রেণির কোন জীব হব। তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তুমি একটা পিশাচকে ভালবেসেছ”।
“ভালবেসেছিলাম।” প্রিয়তা আমাকে শুধরে দিল। 
আমি বিড়বিড় করে নিজেকে শুধরে নিলাম, “ভালবেসেছিলে।”

খানিকক্ষণ কেউ কোন কথা বললাম না। একটু পরে প্রিয়তাই আবার বলল, “পিশাচই যদি হয়ে থাক, আমার একটা অনুরোধ রাখবে?”

কোন উত্তর দিলাম না। প্রশ্নটা উত্তরের আশায় করা হয় নি। 

প্রিয়তাই আবার বলল, “আমাকে একটু বিষ এনে দিতে পারবে?”

এবারও কোন উত্তর দিলাম না। 

==========================================================

আমি লিখে চলেছি-

জীবনে আমার দেখা হয়েছিল শুধু পাহাড়ের সবুজ চূড়াটুকু। তাই, সেখানে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষাটা ছিল সবসময়েই প্রবল। সেটা রৌদ্রেরও ছিল। সত্যি করে বলতে হলে বলতে হয়, আমার চেয়ে খানিকটা বেশিই ছিল। দুজনে ঠিক করেছিলাম, একসাথে একই দিনে দুজনে পালিয়ে বিয়ে করব। করেছিলামও। 

মৌমিতা ঠিক যতটা হঠাৎ করে এসেছিল, রৌদ্রের জীবনে, আমার জীবনে প্রিয়তা এসেছিল ঠিক ততটাই ধীর লয়ে। কীভাবে কেন ঠিক কী কারণে তাকে ভালবেসেছিলাম বুঝতে পারি নি আজও। প্রিয়তার আমাকে ভালবাসার একটা কারণ অবশ্য ও নিজেই বের করেছিল। ও আসলে আমাকে ভালবাসত না। ভালবাসত আমার লেখা গল্পকে। এখানেও আমার আর রৌদ্রের মিল। মৌমিতা আর রৌদ্রের পরিচয়ের সূত্রও রৌদ্রের লেখা গল্প। 

রৌদ্র লেখালেখি করত রৌদ্রোচ্ছ্বাশ ছদ্মনামে। সে থেকেই মৌমিতা ওকে ডাকত, রৌদ্র নামে। আর আমি লিখতাম ক্লান্ত কালবৈশাখি নামে। ক্লান্ত কিংবা কালবৈশাখী কোনটাই মানুষের নাম হয় না বলে প্রিয়তা ডাকত বৈশাখ বলে। এই নামে ডাকতে ডাকতে আমাদের দুজনের আসল নামটাই যেন হারিয়ে গেল চারজনের জগতে। আমার ছদ্মনামের বানান ভুলটা ইচ্ছে করেই করা। কারণটা হতে পারে আমার জীবনটাই ভুলে ভরা। সেখানে কোনোকিছু ঠিকভাবে হলেই বরং বেমানান লাগে। 

ট্রেনে প্রিয়তার হাত ধরে যখন উঠেছিলাম তখন এত কিছু মাথায় ছিল না। মাথায় আনতে হল যখন ট্রেন থেকে চট্টগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশনে নামলাম। কিভাবে পালিয়ে আসব, সেই পরিকল্পনাটা আমরা করেছিলাম খুব সুচারুভাবে। কিন্তু, পালানোর পরে কী করব, মাথায় ছিল না তার কিছুই। তাই ট্রেন থেকে নেমেই যেন পড়লাম অথৈ সাগরে। তারপরের কয়েকটা দিন যে কিভাবে কাটিয়েছি, ভাবলে আজও শরীর শিরশির করে। নিজের ঠিকে থাকার সক্ষমতার ওপর আমার যে মারাত্মক আস্থা ছিল, তা কতটা ভ্রান্ত হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সে কটা দিন যে কিভাবে কাটিয়েছি জানে স্রেফ স্রষ্টা। আমি নিজেও জানি না ভাল মতন। 

অবশেষে মাস খানেক পর ইয়াজুদ্দিন মার্কেটের এক গলির ভেতর একটা ইলেক্ট্রনিক্স সারাইয়ের দোকান দিয়ে দিলাম। সম্বল ছিল মৌমিতার পালিয়ে আসার সময় নিয়ে আসা টাকা, প্রিয়তার মায়ের গয়না আর আমার খেয়ালের বশে শেখা টুকিটাকি ইলেক্ট্রনিক্সের কাজ। ভাগ্যটাও খানিকটা সুপ্রসন্ন ছিল বলতে হবে। দোকান থিতু হতে বেশি সময় নিলো না। আর অনেকের মতে আমরা দুজনেই যদি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়াটা করতাম তাহলে বেশ ভাল ছাত্র হবার যোগ্যতা আমাদের ছিল। পড়াশোনাটা না করা হলেও, দোকানের কাজটা শিখে নিলাম বেশ মনোযোগ দিয়েই। দোকানটা মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় এলে শুরু করলাম ইলেকট্রিকের কাজ করা। এটা পারতাম আরও ভাল। আমাদের গ্রামের বাড়িতে পুরো ইলেকট্রিকের লাইন আমি আমি একাই লাগিয়েছিলাম। 

রেলওয়ে কলোনির একটা বাসায় ভাড়া থাকতাম আমরা। বাসাটা যিনি সরকারের থেকে আড়াই হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছিলেন, তার কাছ থেকেই আমরা ভাড়া নিয়েছিলাম সাড়ে ছয় হাজার টাকায়। এই ব্যবসাটা ইদানীং বেশ ভালমতোই চলে। 

আকাশ থেকে মেঘগুলো সরে যাচ্ছিল বেশ দ্রুত। চৈত্রের প্রখর সূর্যটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল প্রায়শই। আমরা সবাই বুক বেধে ছিলাম তাকে একবার প্রাণ ভরে দেখার জন্য। তার আগমন বার্তাও পেয়েছিলাম। মৌমিতা একদিন লাজুক মুখে আমার ঘরে ঢুকে বলল, “বৈশাখ, তুমি চাচ্চু হতে যাচ্ছ।” 

এক মুহূর্তের জন্য আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আনন্দে। কী বলব, কী করব তার কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মৌমিতা একই ভাবে লাজুক মুখে বেরিয়ে গেল। আমি গিয়ে রৌদ্রকে ধরে ধরলাম, “শ্লা, আমার ভাতিজার খবর আমাকে শুনতে হয় তোর বউয়ের মুখ থেকে! তুই কি বসে বসে ব্যাঙের ঘাস কাটিস?” রৌদ্র প্রিয়তার থেকে বেশি লজ্জায় মুখ কাঁচুমাচু করে ফেলল। দেখে মনে হয় বাচ্চাটা আছে ওর পেটে। ওর অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে গেল। 

কিন্তু, হাসিটার স্থায়িত্ব খুব বেশি সময় হল না। তার পর-মুহূর্তেই আমাকে দাড়াতে হল তীব্র বাস্তবতার মুখোমুখি। একটা সন্তান-সম্ভাবা মেয়ের যতটা সেবাযত্নের দরকার হয় আর তার রেগুলার চেকআপসহ অন্যান্য অনুষঙ্গে কতটা খরচ হয় তা আমাদের কারোরই অজানা ছিল না। প্রিয়তা সেবাযত্নের কোন ত্রুটি করবে না সেটা জানা ছিল খুব ভালভাবেই। কিন্তু, আমাদের আয়টা যেখানে মাসের ত্রিশটা দিনই পাড়ি দিতে চায় না, সেখানে অতিরিক্ত অর্থটা কোথা থেকে আসবে জানা ছিল না কারোরই। তাই যা হবার তাই হল। মৌমিতার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেল দ্রুত।

বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, “বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকেই আসে।” তার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে মাস-খানেকের মাথায় ইয়াজুদ্দিন মার্কেটে আগুন লাগল। কার কী ক্ষয়ক্ষতি হল জানি না। জানার কোন ইচ্ছেও ছিল না। আমাদের দোকানটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, এই তথ্যটাই আমার জানার জন্য যথেষ্ট ছিল। 

চোখের সামনে সব হচ্ছিল কিন্তু করার ছিল না কিছুই। সেই ভয়াবহ সময়গুলোতে আমি করতে পারি নি কিছুই। শুধু একটা কাজই করে গেছি। ক্রমাগত গল্প লিখে গেছি। আমার সুখ দু:খ আনন্দ বেদনাগুলোকে থরে থরে সাজিয়েছি প্রতিটা গল্পের প্রতিটি শব্দের মাঝে। আমার শব্দগুলোই ছিল আমার অনুভূতি। 

ওরা তিনজনেই মনে করেছিল, আমি বোধ হয় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছি। কিন্তু, আমি জানতাম, আমি পুরোপুরি সুস্থ আছি। আগের আমি আর এই আমি'র মধ্যে পার্থক্য একটাই। আগের আমি টিকে থাকার জন্য বেচে থাকতাম। ঠিক একটা গ্ল্যাডিয়েটর এর মত। আর এই আমি পুরোপুরি অথর্ব একজন। পরাজিত একজন। 

==========================================================

নার্সের হাতে রক্ত দিয়ে রৌদ্র আমার পাশে এসে বসল। প্রায় এক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। কেউ কোন কথা বললাম না। হঠাৎ রৌদ্র বলল, “দোস্ত, হাঁটবি?”

একবার ওর মুখের দিকে তাকালাম। মুখ থেকে পরাজিত শব্দটা মুছে গেছে হঠাৎ করেই। দুজন যেন একসাথে আবার ফিরে গেছি ছয় বছর আগের কোন নবীন গল্পকারে। যাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে পুরো খিলগাঁও এলাকা টো টো করে ঘুরে বেড়ান। যাদের পথের কোন শেষ নেই। পথটা সেখানে তেপান্তরের মত বিশাল। সেই বিশাল তেপান্তর আমি রৌদ্রের চোখে মুখে দেখতে পেলাম। 

উঠে দাঁড়ালাম। দেখাদেখি রৌদ্রও। দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলাম হাসপাতাল থেকে। পেছন থেকে প্রিয়তা ডাকল, “কোথায় যাচ্ছ?” কোন উত্তর দিলাম না। ভবঘুরেরা পেছন থেকে ডাকা কারও কথার উত্তর দেয় না। 

দুজন হাঁটছি। অনন্তকাল ধরে। এই পথের কোন শেষ নেই। এই পথের কোন যন্ত্রণা নেই। সব যন্ত্রণা আর পিছুটানকে ধুয়ে মুছে ফেলেই এই পথে নামতে হয়। এই পথে স্রেফ একটাই পাথেয় থাকে। তা হচ্ছে, গল্প। এই পথে গল্প তৈরি হয়। এই পথে গল্প রচিত হয়। এই পথে গল্প পূর্ণতা পায়। 

সব অনুভূতিগুলো থরে বিথরে সাজান থাকে এই পথে। এই পথে সাজান থাকে স্বপ্ন। শুধু তাকে খুঁজে নিতে শিখতে হয়। যে সেটাকে খুঁজে নিতে জানে সেই টিকে থাকে। বাকিরা বিলুপ্ত হয়। আজ আমি এখান থেকে স্বপ্ন খুঁজে বের করব। স্বপ্নেরা আজ এখানে আমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। এই খেলায় আমাকে জিততে হবে। পৃথিবীতে আমি এসেছি টিকে থাকতে। বিলুপ্ত হতে নয়। আমি আজকে স্বপ্নকে খুঁজছি। 

==========================================================

ঘণ্টা তিনেক পর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরলাম। প্রিয়তা একটা চেয়ারে বসে আছে। আমাদের দেখেই বলল, “রৌদ্র, মৌমিতা তোমাকে দেখতে চাইছে।” রৌদ্র প্রায় পাগলের মত দৌড়ে গেল অপারেশন থিয়েটারের দিকে। পেছন থেকে প্রিয়তা জোরে বলল, “ওকে বেডে নিয়েছে।” রৌদ্র দিক বদলে আবার দৌড় দিল সেদিকে। ওর পেছনে আমিও। প্রিয়তা আমার হাত চেপে ধরল। ছাড়িয়ে নিয়ে গেলাম রৌদ্রের পেছনে। 

বেডের কাছে পৌছতেই দেখলাম, রৌদ্র মৌমিতার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মৌমিতার মুখটা বিধ্বস্ত। কিন্তু, সেখানেও লেগে আছে বিজয়ীর হাসি। মৃত্যুকে পরাজিত করে ফিরে আসার জয়োল্লাস। পাশ থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনলাম। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। স্বপ্ন দেখছিল। আমি বিড়বিড় করে বললাম, আমার খুঁজে আনা স্বপ্ন। প্রিয়তা পেছন থেকে এসে আমার হাত ধরল। এবার আর ছাড়িয়ে নিলাম না। বরং আরও শক্ত করে হাতটা ধরলাম। প্রিয়তা বলল, “ভালবেসেছিলাম।” একটু থেমে আবার বলল, “ভালবাসি। ভালবাসব।” 

রৌদ্র এক হাতে শক্ত করে ধরে রাখল মৌমিতাকে। অন্য হাতে তার সন্তানকে। আমাদের নতুন গল্পকে। যে গল্পকে নিয়ে আমরা নতুন করে গল্প লিখব। 

==========================================================

আমি আবার লিখছি। শব্দগুলো আবার ফিরে এসেছে। ওরা ছোটাছুটি করছে পুরো করিডোর জুড়ে। আমি সামলে রাখতে পারছি না। অনুভূতিগুলো তার সর্বোচ্চ তীব্রতা নিয়ে আমার মাঝে বাস করছে। মনে হচ্ছে আমি একটা গ্ল্যাডিয়েটর। এই মাত্র সিংহটাকে হারিয়ে নিজের প্রাণটাকে ফিরে পেয়েছি। আজ আমি বীর। এক সত্যিকারের বীর। আজ আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ গল্পটাকে লিখব। আজ আমি লিখব এক টিকে থাকার গল্প। বেচে থাকার গল্প। এক গল্প লেখার গল্প।


Comments

Popular posts from this blog

নিকষ

বাংলা কবিতায় ছন্দ ; কিছু প্রাথমিক আলোচনা

স্বাতন্ত্রিক