কইতরি
শুনবেন? কি করবেন শুইনা? কি হইব শুনাইয়া? আপনারে শুনাইলে কি আমার মাইয়া ফিইরা আইব? আইব না। ও চাইলেও আইতে পারব না।
তয় আপনারে কমু। সব কমু। কারে কমু আর? কে শুনব? আমার মত আরও কত অভাগা আছে! সবার কষ্ট। আপনেরা সাংবাদিকরা খালি শুইনা যাইতেছেন। আপনাগোরও কষ্ট। চল্লিশটা বছর বুকে পাথর চাপা দিয়া রাখছি। আর কত রাখমু? আমিও তো মানুষ। কষ্ট আর কতদিন বুকের মইধ্যে চাপা দিয়া রাখমু?
আহারে! ফুলের মত মাইয়া আমার। এই তো, সেইদিনও এই উঠানে খেলছে। দাড়িয়াবান্দা, কুতকুত, সাতচাড়া, ছয়-গুটি, বাঘবন্দি... এখনও চোখের সামনে ভাসতেছে। খেলা আর খেলা... আর করবইডা বা কি? ইশকুল বন্ধ। দ্যাশে তখন সংগ্রাম। ইশকুল চলব ক্যামনে? শেখ সাব সেই কি এক ডাক দিল! তারপর যেন সবাই অন্ধ। হ! অন্ধই তো। তার কথা শুননের পর আর কেউ কিছু দেখে না, কেউ কিছু শুনে না, কেউ কিছু বুঝে না। বুঝার চেষ্টাও করে না।
উত্তরপাড়ার রইছ, কলমি-কান্দির আবুল, খাঁ বাড়ির মকলেচ-কুটি-হাসমত, চুকদার বাড়ির রতন-আবুল, সাহাদের বিপিন-রামকানাই, মল্লিকদের শিবনাথ-কৃষ্ণ-গোপাল... সবাই। কারও তখন আর কোন বোধ-বুদ্ধি নাই। শুধু এইটুক জানে দ্যাশ থেইকা মিলিটারি তাড়ান লাগব।
আমিও হয়ত যাইতাম। মা মরা মাইটার জন্য যাইতে পারলাম না। আমি গেলে অরে দেখব কেডা? ভুল কইলাম। আমি অরে কই দেখতাম? অই তো আমারে দেখত। সারাটা গেরাম ঘুইরা আইসা আবার রানতে বইত। ঘর গুছাইত। উঠান ঝাট দিত। গেরস্থলি সামলাইত। কত বয়স হইব তখন? দশ? বেশি হইলে বার-তের। মাইয়ার কামে কোন ক্লান্তি নাই, পরিশ্রান্তি নাই। এই মাইয়ারে রাইখা আমি ক্যামনে যুদ্ধে যাই!
গেরামের মোল্লার কইত মাইয়া আমার ডানপিইট্যা। অরে ঘরে বন্দ কইরা রাখতে। নাইলে, আল্লার গজব পড়ব। মুখের উপরে কিছু কইতে পারতাম না। কইতাম মনে মনে। গজব তগোর উপরে পড়ব। ঠাডা পড়ব আসমানতুন। তোরা মিলিটারির সাথে মিইলা পাখির মত মানুষ মারতাছস। তগো দিলে কি এতটুকু দয়ামায়া নাই? কোন কোরান-হাদিসে লেখা আছে এমনে মানুষ মারতে? এই জুলুম আল্লায় সহ্য করব না। খোদার আরশ কাপতাছে। এর বিচার সে করব।
যুদ্ধে যাইতে না পাইরা মনে মনে আমি যে কি কষ্ট পাইতাম উপরে জানে খোদা আর নিচে আমি। আর জানে আমার মাইয়া। রাইতের বেলা আমার কানের কাছে আইসা কইত, বাজান তুমি আমার লেইগা চিন্তা কইর না। আমি বড় হইছি না? আমার খেয়াল আমি রাখবার পারুম। তুমি যুদ্ধে যাও।
আমি শুইনা হাসতাম। মাইয়ার লেইগা গর্বে আমার বুকটা ভইরা যাইত। অর মাথায় হাত বুলাইয়া কইতাম, না রে মা, আমার কোন কষ্ট নাই। শুধু একবার যদি আল্লায় আমারে মুক্তিবাহিনীর সাহায্য করার তউফিক দিত। যদি তাগো সাহায্য করার একটা সুযোগ পাইতাম।
হ! সুযোগ আল্লায় আমারে দিল। তহন মাইঝ রাইত। মাইয়ারে জড়ায় ধইরা আমি ঘুমাইতেছি। হঠাৎ, কে জানি দরজায় শব্দ করল। আমি দরজার কাছে যাইয়া জিগাইলাম, কে?
অই পাশ থেইকা চাপা গলায় কইল, আমরা মুক্তিবাহিনি। দরজাটা একটু খুলেন।
আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুইলা তাগো ঘরে ঢুকাইলাম। কেউ আবার দেইখা ফালাইল না'কি দেইখা তাড়াতাড়ি দরজা বন্দ করলাম। কইতরিরে ডাইকা তুললাম।
ও, আপনারে তো কই নাই, কইতরি আমার মাইয়ার নাম। মুক্তিবাহিনীর লোক দেইখা তার সেকি আনন্দ, আপনে যদি দ্যাখতেন। যানি কত কথা কইতে চায় কিন্তু, ঠোটে আইসা আটকাইয়া যায়।
মুক্তি বাহিনীর লোক কইল তারা অনেক দুর থেইকা আইছে। সারাদিন কিছু খাওয়া হয় না। তাগরে চাইরটা ভাত দিতে। কইতরি দৌড়ায় যাইয়া চুলা ধরাইল। গরম ভাত, ডিমভাজা, ডাইল আর কাঁচামরিচ। সেই খাবারই তারা যে ক্যামনে খাইল যদি দ্যাখতেন। যেন বেহেশতি খানা। যেন তারা কতদিন কিছু খায়না। আমি আর কইতরি দেখলাম চাইয়া চাইয়া। কারও খাওন দেখনের মধ্যেও যে এত আনন্দ আগে জানতাম না।
হেরা সারাদিন ধইরা আইছে। শইল ক্লান্ত। কিন্তুক, আমার মাইয়ার সেই দিকে খিয়াল নাই। সে সমানে মুক্তিবাহিনীর লগে গল্প শুরু করছে। যেন তারা অর কতদিনের চিনা। ও ভাইজান, এই নাঙলের মত এইটা কি? কি কও! এইটাই রাইফেল? এইটা দিয়াই গুলি বাইরয়? এই লোহার আমের মতন এইটা কি? গ্রেনেড? এই চাবি ধইরা টান দিলে এইটা আগুন অইয়া যাইব? মাইন আবার কি জিনিস? এইটা উপরে কেউ পাড়া দিলে এইটাও আগুন অইয়া যাইব? বাব্বাহ! তোমগো ডর করে না, এইগুলান সাথে নিয়া ঘুইরা বেড়াও?
মুক্তিবাহিনি হাসে। আমি অবাক হইয়া দেখি। এরা এত মারে, এত মরে, এত মরতে দেখে। তারপরেও হাসে ক্যামনে? বুঝি, তাগো দিলটাই পাথর অইয়া গেছে। পাথর কইরা দিছে। আর কত কানব? আর কত দুঃখ সহ্য করব? আগে দ্যাশ থেইকা মিলিটারি তাড়াক। তারপর চিৎকার কইরা কানব। যত দুঃখ আছে মনের ভিতর, সব একবারে বাইর কইরা দিব। তারপর স্বাধীন দ্যাশে স্বাধীন জীবন। ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমাইয়া যাই।
ভোর রাইতে ফজরের নামাজের সময় আমি উঠি। জ্ঞান-বুদ্ধি হবার পর থেইকা আমর কোনদিন এক ওয়াক্ত নামাজও কাজা হয় নাই। উইঠা দেখি তারা সবাই মিইলা শলা-পরামর্শ করতাছে। তাগরে পথ দেখাইয়া নদীর ঘাটে পৌছায় দিতে হইব। তারা সেইখান থেকে ব্রিজটা উড়ায় দিব। সেইখান দিয়া না'কি আজকে গেরামে আরও মিলিটারি আসনের কথা। ব্রিজটা উড়ায় দিয়া তারা এইখানকার মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করব।
একমুহুর্ত ভাবলাম। এখন তাগরে নিয়া গেলে আমার নামাজ কাজা হইয়া যাইব। কিন্তুক, তারপরেই ভাবলাম, এখন নামাজ কাজা হইলে আমার যে গুনা হইব, তার থেইকা অনেক বেশি গুনা হইব যদি তাগর লগে না যাই। তাগরে কইলাম, চলেন।
তারা আমার পিছন পিছন রওনা দিল। নদীর পাড়ে যাওনের রাস্তা মজ্জিদের সম্মুখ দিয়া। আমি আল্লা আল্লা করতে করতে যাইতেছি যেন কারও সাথে দেখা না হয়। আমার কপাল খারাপ। যাওনের সময় আজর মোল্লার সাথে দেখা। আমারে দেইখাই হাঁক দিল, কি মিয়া, নামাজে আইবা না?
কোন রকমে আইতাছি কইয়াই আমি আবার হাটা দিলাম। মোল্লা আর কিছু কইল না। শুধু মুক্তিবাহিনীর লোকগুলার দিকে একবার চোখ বুলাইল। সেই কালসাপের দৃষ্টি। আমি মনে মনে কইলাম, আল্লা না করুক আজর মোল্লা জানি কিছু না বুঝে।
কোন রকমে দুর থেইকা তাগরে ব্রিজটা দেখায় দিয়াই আমি বাড়ির দিকে দোড় দিলাম। মনেপ্রাণে আল্লা খোদার নাম স্মরণ করতাছি, হে আল্লা, আজর মোল্লা জানি কিছু না বুঝে।
করল না। খোদা আমার দোয়া কবুল করল না। কলিম গো ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর পরই দ্যাখলাম, আমার ঘরের সামনে ঘরের সম্মুখে একপাল পিচাশ দাড়াইন্যা। সাথে আজর মোল্লা। সাথে সাথে আমার দুনিয়া জানি আন্ধার হইয়া গেল। আমি পাগলের মত দোড় দিলাম বাড়ির দিকে।
দোড়ানোর শব্দে আজর মোল্লা পিছন ফিইরা আমারে দ্যাখল। তারপর মিলিটারি গো বড় অফিসারের কাছে যাইয়া কইল আমার আসনের কথা। আমি দোড়ায় যাইয়া তার পায়ের কাছে আছড়ায় পড়লাম। অফিসার আমার দিকে ফিইরা কইল, মুক্তি কাহাপার হ্যায়?
আমি পাথরের মতন বইসা থাকলাম। মোল্লা কইল, তাড়াতাড়ি ক। তাইলে তোরও ভালা আমগোরও ভাল। তারপরেও আমারে নিশ্চুপ দেইখা এই সিপাহি আইসা বন্দুকে বাট দিয়া আমারে বাড়ি মারল। আমার নাক দিয়া ফিনকি দিয়া রক্ত বাইর হওয়া শুরু করল। আমি তখন ঠিক কইরা ফালাইছিলাম, আমারে জানে মাইরা ফালাইলেও আমার মুখ থেইকা একটা শব্দও বাইরা হইব না। তারপর আরও কয়েকটা সিপাহি আইসা আমারে মাটিত ফালায়া বুট জুতা দিয়া লাথ্থি মারা শুরু করল। আমি যানি চোখে আন্ধার দ্যাখলাম। এই কষ্টের থেইকা মরণও ভাল। তারপরেও আমি মুখ খুলি নাই।
তখন দেখলাম আজর মোল্লা যাইয়া মিলিটারি অফিসারের কানে কানে কি জানি কইল। তারপর অফিসারের কথা মতন দুইটা সিপাহি যাইয়া আমার দরজায় লাথি মারতে শুরু করল। দেইখা আমার অন্তরাত্মা কাইপা উঠল। ভিতরে কইতরি।
আমার তখন উইঠা দাঁড়ানোর শক্তি নাই। তারপরেও, জান-পরান দিয়া উঠলাম অগোরে থামানোর লেইগা। তখন অন্য দুইটা সিপাহি আইসা আমারে টাইনা-হিঁচড়াইয়া দুরে নিয়া দাঁড়াইল। আমি পাগলের মত চিৎকার করা শুরু করলাম, হে আল্লা এই জালিমের হাত থেইকা আমার মাইয়ারে তুমি বাঁচাও। লাথির চোটে দরজা বেশিক্ষণ টিকল না। দরজা ভাইঙ্গা যাইতেই দেখলাম চৌকাঠে কইতরি দাঁড়ানো। নিজের মেয়েরে মিলিটারির সামনে দেখা যে কত বড় যন্ত্রণার আপনে সেইটা বুঝবেন না।
আজর মোল্লা কইল, তর শেষ সুযোগ। এখনও সময় আছে। ক, মুক্তিবাহিনি কই?
আমি বুকে পাথর চাপা দিয়া থাকলাম। শুধু কোন রকমে উচ্চারণ করলাম, মা কইতরি, তুই আমারে মাফ কইরা দিস। অতিকষ্টে অর মুখের দিকে তাকাইলাম। আশ্চর্য! আপনে বিশ্বাস করতে পারবেন না। সেই মুখে কোন ভয় নাই, কোন ডর নাই, দুঃখ নাই, কষ্ট নাই, বেদনা নাই। খালি দুই হাত পিছনে রাইখা আমার মাইয়া হাসতেছে। আশ্চর্য সেই হাসি! সেই হাসি আমি খালি একবারই দেখছিলাম। কইতরির মা যক্ষ্মায় মরার আগে এমন হাসি হাইসা আমারে কইছিল, আমার কইতরিরে তুমি দেইখো।
আজকে আবার সেই হাসি দ্যাখলাম কইতরির মুখে। হঠাৎ, মনে হইল কইতরি ওর দুই হাতের মইধ্যে কি জানি টান দিল। সাথে সাথে বুঝলাম, ওইটা কি? চিৎকার কইরা কইতে চাইলাম, তুই ওইটা ছুঁইরা ফালায় দে। কিন্তুক, মুখ দিয়া কোন শব্দ বাইর হইল না। শুধু শুনলাম কইতরি কইতেছে, বাজান আমার দ্যাশটারে তুমি দেইখো। আর শুনলাম একটা গ্রেনেড ফাটার বিকট শব্দ।
Comments
Post a Comment