কল্পনার ওপাশে
একটা মেয়ে প্রায়ই আমার কল্পনায় আসে:
শ্যামলা, ছিপছিপে গড়নের। তার দীঘল চুল গড়িয়ে পড়েছে কোমর অবধি। তার পরনে থাকে একটা নীল কামিজ। গলায় একটা সবুজ ওড়না।
তাকে আমি যখনই দেখি তখনই অঝোর ধারায় ধারে বৃষ্টি হতে থাকে। যেন জিউসের শাপে পৃথিবীতে আর একটি মহা প্রলয় সৃষ্টি হয়েছে। এই আর একটু পরেই ডুবতে শুরু করবে পুরো পৃথিবী। অঝোর জল তার পায়ের আঙ্গুলগুলো, ক্রমশ গোড়ালি পার হয়ে হাঁটুর দিকে লোভাতুর চোখে তাকায়।
শ্রাবণের জলে ভিজে তার কামিজের নীল রং তাকে জড়িয়ে থাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। তার সবুজ ওড়না গলায় পেঁচিয়ে থাকে আশীর মত করে। তার শরীরের প্রতিটি ভাজ আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখে যাই। শ্রাবণের জলের মত আমিও লোভাতুর হয়ে উঠি। আমার ইচ্ছে হয় তার আরও একটু কাছে এগিয়ে যেতে। খুব একটু সাহস করে তার হাতটা ধরতে। আমার সাহস হয় না।
তার চার পাশ জুড়ে থাকে সবুজ ঘাস। জীবনানন্দের সুচেতনার হৃদয়ের মত কোমল ঘাস। সেই ঘাসের বিস্তৃতি থাকে তেপান্তরের মত। যতদূর চোখ যায়, বিশুদ্ধ সবুজ স্নানরতা ঘাসই কেবল চোখে পড়ে। সে তরুণীর হৃদয় তখন ঘাস। আকাশের ওপর আকাশ। বাতাসের ওপর বাতাস।
সেই বিস্তৃত প্রান্তরের বাতাসে থাকা গোধূলির ধূলিমাখা আস্তরণ শ্রাবণের জলের সাথে মাটিতে নেমে আসে। সে বাতাসে কেবল থাকে নিকষ শুদ্ধতা।
সেখানের আকাশে সূর্যটা মুখ লুকিয়ে থাকে লজ্জায়। এত মেঘের ঘনঘটায় সে নববধূর মত মুখ লুকিয়ে থাকে এক কোণায়। আকাশ জুড়ে রাজত্ব করে ধূসর মেঘেরা।
সেই অসীমে শেষ হওয়া আকাশ, বাতাস আর ঘাসের মাঝে সে তার দুহাত ছড়িয়ে দেয় এক কাকাতুয়ার মত। সে ডানায় ভর করে সে আকাশে উড়তে চায়। বোধ হয় আমার মুগ্ধতার টানেই সে মর্ত্যেই রয়ে যায়।
কল্পনায় কেবল কারও বাইরের ছবিটাই দেখা যায়। ভেতরটা যায় না। আমি তবু তার ভেতরের মেয়েটাকেও কল্পনা করি।
সেই মেয়েটার তীব্র দৃষ্টি আমার বাইরের আবরণটাকে স্বচ্ছ পর্দার মত ভেদ করে, দেখতে পায় আমার হৃদয়টাকে। তাই সে আমাকে চেনে আমার চেয়েও ভাল করে। তার উচ্ছল মুখটার নিচে বাস করে অসম্ভব দুষ্টু একটা মেয়ে। সবকিছু নিয়ে রসিকতা। এত রসিকতা ভাল লাগে? আমি তবুও মুগ্ধ হই। সে যা করে তার সবই আমার কাছে মুগ্ধতার। সে দু:খ পেলে হাসতে জানে। এক বুক সুখে কাঁদতে জানে। আমাতে খুশি ছড়াতে জানে। আর সে, ভালবাসতে জানে। তার ভেতরটা তার বাইরের মুখের চেয়েও সুন্দর।
কিন্তু, কতটা সুন্দর আমি জানি না। কারণ তার বাইরের মুখটাকেও আমি কখনও দেখতে পাই না। বৃষ্টির উচ্ছলতায় তার মুখচ্ছবিটা আমার কাছে অধরাই থেকে যায়। আমি তাকে ডাকি, 'প্রিয়তা…' সে পিছু ফেরে না। শুধু রিমঝিম শব্দে হেসে ওঠে। তার সেই হাসিতে প্রকম্পিত হয় তেপান্তরের পূর্ব থেকে পশ্চিম। আমি বলি, 'প্রিয়তা, দেখা দাও।' সে অপেক্ষার প্রহরটাকে স্রেফ আরও খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। তার হাসি প্রতিধ্বনিত হয় আমার ঘরের প্রতিটি কোণায়। আমার জগতের প্রতিটি পরমাণুর মাঝে।
সেই কল্পনার মেয়েটিকে এখন আমি আমার সামনে দেখতে পাচ্ছি। তার পায়ের নিচে নরম ঘাস নেই। আছে ইটের ওপর সিমেন্টের আবরণ। তার তেপান্তরের মত বিশাল মাঠটা অনেক ছোট হয়ে একটা তিনতলা বিল্ডিংয়ের ছাদ হয়ে গেছে। একটা ঝাঁকড়া জাম গাছের সাথে হেলান দিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি, তার নীল রংয়ের কামিজ থেকে রং উঠছে। তার সমস্ত শরীরে মিশে যাচ্ছে নীল। তার গলার ওড়নাটা সবুজ না। বেগুনি। তাতে তার রূপে ভাটা পড়ে নি। বরং কেন যেন মনে হচ্ছে সবুজ ওড়নাতে বোধ হয় মানাত না। হাসলাম। আমি জানি, এখন যদি সে একটা কুচকুচে কালো ওড়না পরত, তাহলে আমার মনে হত, কালো ওড়না ছাড়া বোধ হয় তাকে মানাত না। আমি একমনে তাকে দেখছি। ক্লান্তি মাখা মুগ্ধতায়। এত রূপ যে আমার চোখে সইবে না। এই শ্রাবণের জল আর তার মাঝে জলকন্যা। এর চেয়ে মোহময় কিছু কি পৃথিবীতে আর আছে?
'দাদা, বাড়ি ফিরবি না?' বৃষ্টির কোলাহল ভেদ করে হঠাৎ ছোট বোন ঋতুর গলা শোনা গেল।
-না। তুই বাড়ি যা। আমার ফিরতে দেরি হবে।
ঋতু কোন উত্তর দিল না। দোতলা বাড়িটার ছাদের দিকে তাকাল। বললাম, 'প্রিয়তাকে আজকে অপূর্ব লাগছে না রে?'
-হ্যাঁ। লাগছে।
-আচ্ছা, তুই ওর চেয়ে সুন্দর কোন মেয়েকে কখনও দেখেছিস?
-না। দেখি নি।
-এমন কোলাব্যাঙের মত মুখ করে সব কথার উত্তর দিচ্ছিস কেন?
ঋতু কোন উত্তর দিল না। আমিই আবার বললাম, 'পেঁচার মত মুখ করে আছিস কেন?'
হঠাৎ, ঋতু চিৎকার করে উঠল, 'দাদা, তোকে কতবার বললে বুঝবি, প্রিয়তাদি নেই। প্রিয়তাদি মরে গেছে। ওখানে, ওই ছাদে কেউ নেই। ভাল করে তাকিয়ে দেখ। ছাদটা একেবারে খালি।'
সাথে সাথে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ঋতুর চুল টেনে ধরে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ওকে একটা চড় মারলাম। ঋতু ছিটকে পড়ে গেল। আমার রাগ বিন্দুমাত্র কমে নি। আবার তেড়ে গেলাম ওর দিকে। কিন্তু, কী ভেবে থেমে গেলাম। ঋতু উঠে দাঁড়াল। ঠোটটা কেটে গেছে। ধরা গলায় বলল, 'দাদা... চল।' মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ঋতু চলে গেল।
আমি আবার ছাদের দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। এ কি! প্রিয়তা নেই! প্রিয়তা চলে গেছে? বৃষ্টি তো শেষ হয় নি। এরই মাঝে প্রিয়তা চলে গেল? বৃষ্টি শেষের আগেই?
জাম গাছটার নিচে বসে পড়লাম। প্রিয়তা নিশ্চয় এখনই আসবে। অপেক্ষা করছি। যেন অনন্ত কাল ধরে। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, টের পেলাম না নিজেই।
ঘুম ভাঙ্গল বজ্রপাতের শব্দে। আবার অঝোর বর্ষণ শুরু হয়েছে। আধো তন্দ্রায় চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম, প্রিয়তা আমার সামনে বসে আছে। উল্লাসিত হয়ে উঠলাম। শিশুর মত বললাম, 'প্রিয়তা... তুমি এসেছ? দেখলে ঋতু বলছিল, তুমি নেই। তুমি মিথ্যে। ওকে একটু বকে দেবে তো!'
প্রিয়তা বলল, 'আমি আছি।' পরম মমতার সাথে।
আমি মুগ্ধতায় চুপ করে থাকলাম। প্রিয়তা আমার হাত ধরল শক্ত করে। আশ্চর্য শীতল হাত।
বললাম, 'তুমি আর কখনও ছেড়ে চলে যাবে না তো?'
-আমার সময় যে অনেক কম।
-কিন্তু, তোমাকে ছাড়া আমি থাকব কীভাবে?
প্রিয়তা কোন উত্তর দিল না। আবার জিজ্ঞেস করলাম, 'কিছু বলছ না যে?'
প্রিয়তা মুখে আলতো একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, 'তুমি যাবে আমার সাথে?'
-কোথায়?
-নাই না জানলে। আমার ওপর বিশ্বাস নেই?
-আছে। আমি আমার চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি তোমাকে। তুমি যেখানে যেতে বলবে, আমি অন্ধের মত করেই তোমায় অনুসরণ করব।
প্রিয়তার হাসি তার পুরো মুখে ছড়িয়ে গেল। এক স্বর্গীয় স্নিগ্ধতা। প্রিয়তা উঠে দাঁড়ালো। আমিও। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম তিন তলা বাড়িটার ছাদে। প্রিয়তার দেখাদেখি, উঠে দাঁড়ালাম রেলিংয়ে। একবার নিচে তাকালাম। একটা মেয়ে শুয়ে আছে। লাল শাড়ি পরা। তার মাথার কালো চুলগুলোও লাল হয়ে আছে। পার্থর সাথে প্রিয়তার যেদিন বিয়ে হবার কথা ছিল সেদিনও প্রিয়তা ঠিক এমন লাল একটা শাড়ি পরেছিল। তার আগের দিন আমার বুকে একটা নোনা জলের সমুদ্র তৈরি করেছিল। আমি অথর্বের মত ওর কান্না শুনেছিলাম। করতে পারি নি কিছুই। প্রিয়তাই করেছিল যা করার। ওর যতটা সাহস ছিল, তার সিকিভাগও যদি আমার থাকত!
প্রিয়তা বলল, 'কী ভাবছ?'
-কিছু না।
-তাহলে আমার হাতটা ধর।
শক্ত করে হাতটা ধরলাম। যেন আর কখনও ছাড়িয়ে নিতে না পারে।
বললাম, 'নিচে ওটা কে শুয়ে আছে?'
প্রিয়তা হেসে ফেলল। একটু পরেই আবার হঠাৎ করেই থেমে গেল। এক আকাশ বিষাদ ভর করল, তার মুখে। বলল, 'ওটা তো আমিই।'
কিছু বললাম না। হঠাৎ দেখলাম পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা মেয়েটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য? প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য? আড়ষ্ট- অভিভূত হয়ে গেছি আমি।
যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে ম’রে গিয়েছে, আমিও তাদের একজন হলাম। যে বৃষ্টিরা হাজার হাজার বছর আগে ঝরে গিয়েছে আমিও তাদের একজন হলাম। যে নীল রং আমার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে, আমি হাজার হাজার বছরের জন্য তাকে আলিঙ্গন করলাম।
Comments
Post a Comment