শেকড়
প্রিয়তা মিটিমিটি হাসছে। দেখতে ভাল লাগছে। আমি জানি আমার ততক্ষণই ভাল লাগবে, যতক্ষণ ও চুপচাপ এই হাসি হাসবে। এরপর যখনই কথা শুরু করবে, তখনই ওর ওপর মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু করবে।
প্রিয়তাও সেটা জানে। তাই ওর ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে আমার মন ভাল রাখতে চাইছে। যেন মেজাজ খারাপ করতে সময় লাগে। আমি প্রাণপণে চাইছি যেন মেজাজটা গরম থাকে। পারছি না। ওর হাসি দেখলে বোধ হয় স্বয়ং ঈশ্বরও কারও ওপর ক্রুদ্ধ হতে পারবেন না। আমি পৃথ্বীর কীট তো কোন ছাড়।
-বারান্দায় যাবে?
কথাটায় মেজাজ খারাপ করার মত কিছু খুঁজে পেলাম না। তবুও মেজাজ খারাপ করলাম।
-একটু পরে বৃষ্টি নামবে। এখন বারান্দায় গেলে ভিজে যাবে।
-বৃষ্টি নামবে একটু পর। আর বারান্দায় গেলে ভিজব এখন?
বলেই প্রিয়তা শব্দ করে হাসতে লাগল। তার ভুবন ভোলানো হাসি। নিজের ওপর মেজাজটা খারাপ হল। এই মেয়েটার ওপর আমি মেজাজ খারাপ করতে পারি না কেন?
প্রিয়তা হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গেল। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে ছাড়ালাম না। হয়তো, সারা জীবনের জন্যই তখন ছেড়ে দিতে হবে।
দু’জনে বারান্দায় দু’টো মোড়ায় বসলাম। প্রিয়তা একমনে আকাশ দেখছে। ওই কতগুলো জঘন্য সাদা, ধূসর আর কালো রংয়ের আঁকিবুঁকির মধ্যে এভাবে দেখার কি আছে ওই জানে। অথচ, ওর মুখ দেখলে এখন মনে হবে, ও মোনালিসা বা দ্য লাস্ট সাপারের মত কোন শিল্পকর্ম দেখছে। বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ও আকাশ থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
-ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কিসের ওপর সব থেকে বেশি বিরক্ত।
-নিজের ওপর।
প্রিয়তা হাসল। কিছু বলল না। ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করবে, আমার ওপর আমি কেন বিরক্ত। করল না। অগত্যা নিজেই বললাম-
-নিউ অরলিন্সে সেটল হয়ে যাবার পরেও আমি কেন যে এই জঘন্য দেশটায় আসতে রাজি হলাম! আর তার চেয়ে বড় ভুল করেছ, ঢাকায় নিজেদের এত বড় ফ্লাট থাকতে তাতে না উঠে এই অজ-পাড়াগাঁয়ে এসেছি। কোন কুক্ষণে আমি এই স্যাঁতস্যাঁতে পানি-কাঁদার দেশে আসতে রাজি হয়েছিলাম ঈশ্বর জানেন!
-তার মানে এখন তুমি সব থেকে বেশি বিরক্ত আমার ওপর। না’কি?
কিছু বললাম না। ওকে বোঝাতে হবে, আমি সত্যিই প্রচণ্ড বিরক্ত। প্রিয়তাই একটু পরে আবার বলল-
-তোমার ‘ঈশ্বর জানেন’ কথাটা শুনে একটা কথা মনে পড়ল। বলব?
কিছু বললাম না। খুব ভাল করেই জানি আমি মানা করলেও প্রিয়তা বলবে। তাই হল।
-এ দেশটার মানুষগুলো কখনও ধর্ম নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামায় না। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে ধর্মকর্মের মনও থাকে না। তাদের কাছে ধর্ম সপ্তাহে একদিন মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া। ঈদ কিংবা পুজো তাদের কাছে ধর্মীয় কোন বিষয় না। একটা উৎসব। কিন্তু, এই মানুষগুলোকেই যখন তুমি তাদের ধর্ম নিয়ে একটা বাজে কথা বলবে, দেখবে এখানে রীতিমত দাঙ্গা লেগে যাবে। তোমার অবস্থাটাও হয়েছে তেমন। এ দেশটাকে তুমিও খুব ভালবাস। কিন্তু, যখনই আমার এই হঠাৎ বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ কাটানোর শখ হল, অমনি তুমি ক্ষেপে উঠলে আর সব রাগ ঝাড়ছ এখন এই দেশের ওপর। কি আর করবে বল? এ মাটিরই তো সন্তান।
আমার রাগ করা উচিত কি’না বুঝতে পারছি না। প্রিয়তাকে এখন কিছু কঠিন কথা শোনানো দরকার। কঠিন কথা মাথায় আসছে না। বারবার ওর কথাগুলোই মাথায় ঘুরছে- ‘তুমি তো এই মাটিরই সন্তান’। কথাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছি। পারছি না। কেন, কে জানে?
প্রিয়তা উঠে সামনের দিকে পা বাড়াল। আমি ধমকের গলায় বললাম-
-এখনই বৃষ্টি নামবে। ভিজে নিউমোনিয়া বাধাবে। চুপচাপ বসে থাক।
-ভিজব বলেই তো যাচ্ছি। তোমার কি মনে হয়? বাংলার পহেলা বৈশাখ এমনি এমনি এমন বিশেষ কিছু? না মহাশয়। বাংলার প্রকৃতিও জানে, এটা একটা বিশেষ দিন। তাই সে বছর ঘুরে অপেক্ষা করে এই দিনটার জন্য। জলের আয়নায় বারবার চোখ মেলে নিজেকে সাজায়। মেঘেরাও জানে এটা একটা বিশেষ দিন। তাই সে দুর-দূরান্ত থেকে উড়ে এসে জড়ো হয় আজকে দিনে ঠিক বাংলার ওপর। বাতাসও জানে এটা একটা বিশেষ দিন। তাই সে তার সবটুকু খরতাপ মুছে শীতল চাদর গায়ে জড়িয়ে নেয়। শুধু এই দিনটার জন্য। বৃষ্টিরাও জানে এটা একটা বিশেষ দিন। তাই এতদিনের সঙ্গী মেঘকে ছেড়ে নেমে আসে কাদার মাঝে। সবাই জানে। শুধু তুমি জান না।
একটু থেমে আবার বলল-
-উহু! তুমিও জান। কিন্তু, স্বীকার কর না।
-প্লিজ তোমার এই অতি উচ্চস্তরের ফিলসফি এখন বন্ধ রাখবে? আমার মেজাজ এখন প্রচণ্ড খারাপ।
প্রিয়তা হেসে ফেলল।
-তাহলে বসে আছ কেন? এসো। বৃষ্টিতে। দেখবে, কতটা আদর করে তোমার হৃদয় থেকে সবটুকু মন খারাপ ধুয়ে মুছে দেবে। তুমি টেরও পাবে না। শুধু একটু পরে দেখবে, তোমার মাঝে আর কোন বিষণ্ণতা অবশিষ্ট নেই।
ওর থেকে মুখ সরিয়ে নিলাম। ও গিয়ে উঠোনে দাঁড়াল। আমগাছটার ঠিক নিচে। বাতাসে ওর চুলগুলো রণাঙ্গীনীর মত উড়ছে। এবং একইভাবে উড়ছে, আমগাছের পাতাগুলো। কোথাও এখনও মুকুল। আর কোথাও ছোট আম বেরিয়েছে। দু’টোই ঝরে পড়ছে সমান হারে। যেন পাল্লা দিয়েছে, কে কার থেকে বেশি ঝরতে পারে। বিরক্তিকর একটা দৃশ্য। কিন্তু, কোন অজানা কারণে, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি। কাদামাটির দেশে ধুলো-ঝড় কোথা থেকে শুরু হল বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, প্রকৃতি ঠিক করেছে, আজ পৃথিবীর শেষ দিন। আজকের পর মহাবিশ্বের ইতিহাস থেকে পৃথিবী নামক গ্রহটি মুছে যাবে। তার সব আয়োজন প্রকৃতি করে ফেলেছে। একটু পরেই শুরু হবে সেই ধ্বংসযজ্ঞ। কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলা। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি অধীর আগ্রহে সেই তাণ্ডবলীলার জন্য অপেক্ষা করছি। মনে হচ্ছে, সেই তাণ্ডবলীলাই হবে, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ দৃশ্য। কেন মনে হচ্ছে, জানি না। কিন্তু, মনে হচ্ছে।
ধুলো আর শুকনো পাতায় উঠোন ছেয়ে গেছে। সেই সাথে আমের মুকুল। বাতাসের ছন্দে সবাই মিলে নৃত্যানন্দে মেতে উঠেছে। আমের মুকুল ছোট, পৃথিবীতে নতুন। কিছু দেখলে সে লাফালাফি করতেই পারে। কিন্তু, বুড়োটে শুকনো পাতাগুলোও একই কাজ করছে। কেন করছে জানি না। হয়ত, এই কালবোশেখির প্রকৃতিই এমন। এই বৈশাখের রুদ্রতা যে দেখেছে, সে আর স্থির থাকতে পারে নি। তাই হয়তো, এই ছোট্ট ভূখণ্ডটা জন্ম দিতে পেরেছে, এত কবিতা, এত গান, এত পালা, এত কাব্য, এত সাহিত্য, এত গল্প, এত উপন্যাস। এবং এত অনুভূতি। এবং এত উচ্ছলতা। মনে হচ্ছে, বৈশাখের তাণ্ডবলীলা যে একবার দেখেছে তার ঘরে বসে থাকা অসম্ভব। তাকে তাণ্ডবের মাঝে গিয়ে দাড়াতেই হবে।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। কোন অদৃশ্য শক্তির টানে আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছি উঠোনের ঠিক মাঝখানটায়। কালবৈশাখীর কোন ক্লান্তি নেই, কোন পরিশ্রান্তি নেই। অক্লান্ত কালবৈশাখী। তার ঝাপটার কোন শেষ নেই। বাতাসের তীব্র ঝাপটা আমাকে ফেলে দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু, ফেলছে না। প্রিয়তা এসে আমার সামনে দাঁড়াল। বিজয়ীর গলায় বলল-
-বলেছিলাম না?
আমি জড়ানো গলায় শুধু একটা শব্দ উচ্চারণ করলাম-
-ভালবাসি।
-কাকে? আমাকে?
একরাশ মুকুল আছড়ে পড়ল প্রিয়তার চুলে। স্বর্গের কোন অপ্সরী এখন এখানে থাকলেও হয়তো লজ্জা পেয়ে চলে যেন। সেই রূপেও আমি মোহিত হতে পারলাম না। তার চেয়ে বড় রূপসীকে আমি এখন দেখছি। বৈশাখের উন্মত্ততা আমার হৃদয়ে তোলপাড় করছে। অথচ, আমি আশ্চর্য রকমের শান্ত হয়ে দাড়িয়ে আছি। প্রিয়তা আবার জিজ্ঞেস করল-
-কাকে ভালবাস?
এবং আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সহজ সিদ্ধান্তটা জানালাম।
-তোমাকে নয়। এই দেশটাকে। দেশের বৈশাখটাকে। তোমার চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভালবাসি।
Comments
Post a Comment