ক্লেদ

(১)

ঠাস! শব্দটা কি এমনই কিছু হল? বোধ হয় না। বোধ হয়! বেশ ওপর থেকে কিছু পড়লে এমনই কোন শব্দ হওয়ার কথা। তবে, তার সাথে যদি কয়েকটা হাড় ভাঙ্গা আর একটা খুলি ভেঙ্গে মগজ ছিটকে যাওয়ার শব্দ যুক্ত হয়, তাহলে সম্মিলিত শব্দটা অন্যরকম কিছু হওয়ার কথা। বোধ হয়!

শব্দটা কেন করলাম আমি? জানা নেই। সবকিছুর কারণ থাকতে হবে, তার কোন কারণ নেই। বোধ হয়, হঠাৎ সাধ জেগেছিল। সাধ মেটালাম। জীবনানন্দের মত করে — 

  কাল রাতে- ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
  যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
  মরিবার হ’লো তার সাধ।

কাল রাতটা ফাল্গুনের রাত নয়। চৈত্রের। অবশ্য পঞ্চমীর চাঁদ ছিল আকাশে। ডুবে থাকা চাঁদ। মরিবার হল সাধ। কারণ কি সত্যিই ছিল না? কে জানে!

জীবনটা আমার কাছে অন্য রকম। জীবন হচ্ছে টুকরো টুকরো ব্যর্থতার সমষ্টি। কখনও কম কখনও বেশি। ব্যর্থতাগুলোর ভাজে ভাজে টুকরো টুকরো হাহাকার লেপ্টে থাকে। ব্যস! এই তো জীবন। কত দারুণ ‘জীবন’! প্রেম ছিল, আশা ছিল — জ্যোৎস্নায়। ধোঁয়া ছিল, চায়ের কাপ ছিল, স্বপ্ন ছিল, মেঘদল ছিল… মানুষের সুদীর্ঘ জীবনকাল কাটিয়ে দেয়ার জন্য ওটুকু যথেষ্ট হবার কথা। আমার হয়নি। চাওয়াটা চিরকালই বড্ড বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। ‘নিজের যোগ্যতার দিকে না তাকানো’ রকমের বেশি। কতটা একঘেয়ে মানুষ ছিলাম, খুব ভাল মতন জানি। অথচ, সাধ ছিল বন্ধুত্বের! প্রতিটা মুহূর্তে পাশে কাউকে। মানুষ আমার কতটা অসহ্য লাগতো, জানি। অথচ, চাইতাম তীব্র হাহাকার মুহূর্তে কেউ এসে চুপচাপ পাশে বসে থাক। আমার পাশে বসে থেকেও কেউ আমার ভেতরটা দেখবে না, জানি। অথচ চাইতাম, কেউ আমার হৃদয়টা খুবলে নিতে জানুক। অথচ ওটুকু সাধ সবারই থাকে। অথচ ওটুকু সাধ সবারই অপূর্ণ থাকে। কেউ কেউ হেরে যায়। বাকিরা আরও খানিকটা ব্যর্থতার জন্য অপেক্ষা করে। তারপর একদিন সবাই হেরে যায়। শুধু কেউ আগে আর কেউ পরে। আমার যতটা পরে হেরে যাবার কথা ছিল, তার খানিকটা আগেই হেরে গেলাম।

ঘটনাগুলো হাস্যকর! কেউ পাশে নেই, মন খারাপ। অনেক মানুষ পাশে, মন খারাপ। কেউ বুঝতে পারছে না, হাহাকার। কেউ বেশিই বুঝে ফেলছে, নিজেকে ছোট মনে হওয়া। বন্ধু হয়েছিল। সরেও গিয়েছিল। সবার সাথে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে। বোধ হয়, আমিই করেছি। কিংবা খানিকটা দায় তাদেরও দেয়া যায়। কিন্তু অবশেষে বুঝেছি, লাগামছাড়া আত্মকেন্দ্রিকতা দিনশেষে মানুষকে এক আকাশ একাকীত্ব ছাড়া কিছুই দিতে পারে না। 

  তবু একা-একা,
  যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

বুঝতে দেরি হয়ে গেছে। কেউ বোঝায়নি। যখন চোখ খুলেছি, চারপাশে আলোর মত মিথ্যে নির্জনতা। 

অনেকগুলো রাত ঘুম হয়নি। তারপর ভাবলাম, এবার ঘুমোই। ঘুমিয়ে গেলাম। 

মগজের চারপাশ থেকে কালচে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে গিয়ে ড্রেনের আবর্জনার সাথে মিশছে। যখন আমি ছোট ছিলাম, মানে যখন আমি ছোটদের মত করে ভাবতাম, তখন কে যেন বলেছিল, যাদের মন পরিষ্কার তাদের রক্ত লাল। আর যাদের মনে দুষ্টুমি বেশি, তাদের রক্ত কালো। কে জানে, আমার চিন্তায় সত্যিই ক্লেদ বেশি ছিল কি’না। কে জানে, চিন্তাগুলোও হয়তো রক্তের সাথে চুইয়ে চুইয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। যাক! তার চেয়ে বরং ঘুমাই এবার।

  এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!
  রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
  আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
  কোনোদিন জাগিবেনা আর।

আরও কিছু কী ভাবছিলাম আমি? বোধ হয়! বোধ হয়, চিন্তাগুলো সত্যিই রক্তের সাথে ভেসে যাচ্ছে। স্ফেনয়ডাল বোনের সাথে গোটা কতক চিন্তাও বোধ হয় ভেঙ্গে গেছে। যাক! সাইনাসের ব্যথা যখন তার প্রবল বিভীষিকা নিয়ে হাজির হত, আমার নিজেরই মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত, ওটাকে ধরে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলি। ওই যন্ত্রণা থেকে তো বেঁচে গেলাম। বেঁচে গেলাম, তথাকথিত সফল হওয়ার যন্ত্রণা থেকে। সবার প্রত্যাশা পূরণ করার যন্ত্রণা থেকে। কেউ নিজের প্রত্যাশা পূরণ না করার যন্ত্রণা থেকে। ভাল থাকার মুখোশটার যন্ত্রণা থেকে। কান্নাগুলো লুকোনোর যন্ত্রণা থেকে। সকল যন্ত্রণার ক্লান্তি থেকে। 

  জানি- তবু জানি
  নারীর হৃদয়- প্রেম- শিশু- গৃহ- নয় সবখানি;
  অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-
  আরো-এক বিপন্ন বিষ্ময়
  আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
  খেলা করে;
  আমাদের ক্লান্ত করে;

ভাল ছিলাম না। তবে, ভাল থাকব। চুপচাপ ঘুমাই এবার। প্রশান্তিরা ইঁদুরের মত ছোটাছুটি করছে চারদিকে।

  চমৎকার! —
  ধরা যাক দু’-একটা ইঁদুর এবার –


(২)

বেশ দূরের ল্যাম্পপোস্টটার আলো টংয়ের দোকানটার ওপর এসে পড়েছে। তারপর টংয়ের দোকানটা থেকে একটা তীর্যক সুদীর্ঘ ছায়া এসে পড়েছে আমার মৃতদেহের ওপর। আমি আপাতত ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। আমার মৃতদেহ আমার চেয়ে পাঁচতলা নিচে মিশরীয় চিত্রলিপির মত অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করে শুয়ে আছে। রেলিং থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আজকের মত অনেকখানি মরেছি। কাল আবার হবে। প্রতিদিনই একটু একটু করে মরছি। 

ওহ! বলতে ভুলে গেছি। জীবন শুধু টুকরো টুকরো ব্যর্থতার সমষ্টি না, জীবন টুকরো টুকরো মৃত্যুরও সমষ্টি। প্রতিদিনই মরতে থাকি একটু একটু করে। তারপর যখন শরীরটা মরে যায়, তখন মরার মত কিছু বাকি থাকে না। পুরোটাই মরে যাই, তার অনেক আগেই। 

Comments

Popular posts from this blog

কল্পনার ওপাশে

বৃষ্টিবিলাস অধ্যাদেশ