Posts

Showing posts from May, 2022

বৃষ্টিবিলাস অধ্যাদেশ

তারপর একদিন অধ্যাদেশ জারী হবে বৃষ্টি বিলাসের।   তারপর একদিন বৃষ্টি হবে। তারপর একদিন বৃষ্টি হলে, সহসাই সময়েরা স্থির হয়ে যাবে। স্যারের ঘুম পাড়ানি গান শুনতে শুনতে, সবচেয়ে দুষ্টু মে’টা সহসাই চমকিত হয়ে উঠবে প্রবল তর্জন গর্জনে। পুনরায় বৃষ্টি হলে সকলের জলস্নান বাধ্যতামূলক করা হবে। সবচেয়ে ঘরকুনো ছেলেটাই চুপিচুপি বারান্দা পেরিয়ে, দু’হাত বাড়িয়ে দেবে অঝোরেতে। বিল্ডিং পেরিয়ে চোখ বাড়াবে নীল বরণা তরুণীতে।   তারপর একদিন বৃষ্টি হবে। তারপর যেইদিন আকাশটা ভেঙ্গে যাবে, সকল স্কুল-অফিস-আদালত-কর্মক্ষেত্র অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত ঘোষণা হবে। কর্পোরেট স্বামী ঘরে ফেরার রাস্তায়_ নীল একটা গোলাপ কিনে নেবে সহসাই। সেই নীল গোলাপটা সাবিত্রিকে হাঁটু গেড়ে অর্পণ করবে, না লুকিয়ে বিছানাতে রেখে দেয়া হবে— তা নিয়ে বৃষ্টি-বিলাস অধ্যাদেশে সুনির্দিষ্ট কিছু থাকবে না।   আবার যেদিন সূর্য লুকোচুরি খেলবে, মোড়ে টংয়ের দোকান ছাড়া আর কিছু খোলা থাকবে না সেইদিন। বেশ কড়া লিকারের একটা চায়ের সাথে, এক শলা গোল্ডলিফ শক্ত করে টান দেয়া হবে শুধু_ কেউ যেন সেটা রেগে টান দিয়ে ফেলে দেয়। বৃষ্টি-বিলাস শীর্ষক অধ্যাদেশে কারো ফাঁকা একক হাত ...

স্বাতন্ত্রিক

মেয়েটি জন্মাতে চাইল। আমি তার হৃদপিণ্ডের ভেতর হাত ঢুকিয়ে, তার হৃদয়টাকে টেনে বের করে আনলাম। সে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে আলোকপ্রাপ্ত হল। সে জন্মালো। মেয়েটি আশ্রয় চাইল। আমি সূর্যটাকে ঠেলে সরিয়ে অধিষ্ঠিত হলাম আর সমগ্র আকাশ পটে আমি জড়িয়ে রাখলাম নিজস্বতাকে। সে আশ্রয় নিল বুভূক্ষের মত। সে আঁখি লুকালো। সে আঁখিজল লুকালো। মেয়েটি বিস্তৃতি চাইল। আমি একটা, দু'টো, তিনটে করে তার একষট্টি হাজার বোধ ছড়িয়ে দিলাম আকাশের গায়ে মেঘের মত করে। সে বিস্তৃত হল নগরায়নের মত। সে বিস্তৃত হল পারমাণবিক বিস্ফোরণের মত। মেয়েটি স্বাতন্ত্র চাইল। আমি শ্রাবণকে তার মাঝে গেঁথে দিয়ে আমিত্বকে লুকোলাম  ধূসরের আড়ালে আর তাকে ঝরতে দিলাম স্বাতন্ত্রিকতায়। কেউ মুগ্ধ হল। অজস্র মুগ্ধ হল। অজস্র শ্রাবণস্নানে রত। আমি একাকীত্ব চাইলাম।

অথচ ২

 অথচ তখনও নিউরনে নিউরনে মিশে যাওয়া হয়নি। অথচ তখনও কামড়ে ধরে রাখতে রাখতে জোড়া লেগে যায়নি দু’ঠোঁট। অথচ তখনও এত জোরে আঁকড়ে ধরা হয়নি, যেভাবে তুমি আর আমি হয়ে যাই আমি আর তুমি। অথচ তখনও ততটুকু ঘৃণা করা হয়নি, ততটুকু ভালবাসা হয়নি, যতটুকু হলে ফুরিয়ে যায় বোধ।   অথচ এখনও আমি প্রবল অতৃপ্ত! অথচ এখনও আমি বুভূক্ষের মত আঙ্গুল কামড়ে ধরি। অথচ এখনও আমি পিঁপড়ের মত করে তেপান্তর পার হচ্ছি, ওপারে ভালবাসার সমাপ্তি। অথচ এখনও আমি তীর দেখি না। অথচ এখনও আমি তরী দেখি না। অথচ এখনও ভাবি ভালবাসা… ভালবাসা… ভালবাসা… অথচ এখনও ভাবি অতৃপ্ত… অনন্ত… অসীম।   অথচ এখনও ততটুকু চোখে চোখ রাখা হয়নি, যতটুকু রাখা হলে মানুষ আর মানুষে মিলে হয় গাছ। অথচ এখন ততটুকু উত্তাপ আসেনি যতটুকুতে দু’জনে বাষ্পের মত করে মিলিয়ে থাকে। অথচ এখনও ততটুকু কাঁদোনি, যত কান্নায় ঝরে যায় সব পাঁপড়ি। অথচ এখনও ততটুকু হাসোনি, যত হাসিতে কাঁদতে ভুলে যাও।   অথচ এখনও অতটুকুর ভার বইতে শেখোনি? অথচ এখনও পৃত্থীর কান্না ডোবায় তোমাকে? অথচ কান্নারঙা ভালবাসার ভারে এখনই যদি তুমি মিশে যাও মাটিতে! অথচ আমার ভালবাসা তখনও ফুরায়নি। মরে যাও! মরে যাও! মরে যাও!   ...

যদি তুমি ভুলে যাও আমাকে

 আমি চাই তুমি জেনে রাখো এক পরম বোধি। তুমি কি জানো তা কেমন: যদি আমি তাকাই স্ফটিকায় চাঁদের দিকে, কিংবা আমার জানালায় মন্থর হেমন্তের কোন লালচে শাখায়, যদি আমি স্পর্শ করি আগুনের সন্নিকটে স্পর্শাতীত ছাইকণা, কিংবা কোন অশীতিপর গাছের গুঁড়ির বলিরেখার শরীর, তার সবকিছু আমাকে তোমার কাছে বয়ে নিয়ে যায়। যেন যা কিছু সত্য, অস্তিমান, সৌরভ, আলো, অন্ধকার, সবকিছু ডিঙিনৌকার সারি; যা বয়ে যায় আমার অপক্ষায় থাকা তোমার ছোট্ট দ্বীপের অভিমূখে। তবুও এখন যদি একটু একটু করে তুমি বন্ধ করো আমাকে ভালবাসা, আমিও বন্ধ করে দেবো তোমাকে ভালবাসায় একটু একটু করে। যদি হঠাৎ তুমি ভুলে যাও আমাকে, তোমার দু'টি চোখ যদি আর না খোঁজে আমাকে, আমি তোমাকে ভুলে গিয়েছি এরই মধ্যে। যদি তুমি ভাবো এসব পাগলাটে আর দীর্ঘ, আমার জীবন জুড়ে বয়ে চলা এই উন্মত্ত ঢেউয়ের সারি, এবং তুমি সিদ্ধান্ত নাও আমাকে হৃদয়ের উপকূলে ফেলে যাওয়ার যেখানে আমি শিকড় গেঁড়ে বসে আছি, মনে রেখো, ঠিক সেই দিনে, ঠিক সেই প্রহরে, আমি দু'হাত ছড়িয়ে দেবো আকাশে, আর আমার শিকড় উপড়ে যাবে দ্বীপান্তরের খোঁজে। তবে, যদি প্রতিদিন, প্রতি প্রহরে, তুমি অনুভব করো আমিই তোমার গন্তব্য স্পর্শাতীত আদরে মো...

ঘোড়দৌড়

 অথচ সাত সমুদ্দুর তেরো নদীরে ভাবতাম — সবচেয়ে সুদীর্ঘ দূরত্ব। অথচ তেপান্তর বলতেই দেখতে পাইতাম — এক অনির্নেয় দীর্ঘসূত্রিতা। অথচ মনে হইতো ”বাকি জীবন সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো“ সবচেয়ে একঘেয়ে সমাপ্তি। অথচ, দেখো... অথচ... ঘর-দোর-উঠোন ফালাইয়া সত্তুরটা সমুদ্দুর আর একশ ত্রিশটা নদীর পরে এই পাথর আর ম্যাপল গাছের শহরে দূরত্বের হিসাব আর কষতে বসা হয় না। অথচ, দেখো... অথচ... এই অতলান্তিকের কালচে জল তেপান্তরের মরিচিকার চাইতে বড় বিভ্রম কি′না — সেই হিসাব আর কষতে বসা হয় না। অথচ, দেখো... অথচ... মাঝ রাত্তিরে আমার মাথার ভেতর কিলবিল করা খোক্ষসগুলার চাইতে  আমাদের এই একষট্টি আলোকবর্ষ দূরত্ব বেশি বিভীষিকাময় কি'না সেই হিসাব আর কষতে বসা হয় না। এই ঊনিশশো চৌত্রিশের ঘোড়দৌড়ে তেপান্তরও মাইক্রোস্কোপিক হয়া যায়। বিগত দুই যুগের স্বপরিকল্পিত ঘোড়দৌঁড়ে ইস্তফা দিয়া আমি এখন একটা ব্যাঙ্গমার মতোন স্থির হয়া বসতে চাই। বাকি জীবন সুখে শান্তিতে বসবাসের কপাল না হোক, বাকি জীবন পাশাপাশি বসবাসের কপালটা হোক।

মেঘটা

 নিযুত বছর আগে এক শ্রাবণ-সংক্রান্তির রাতে আমাকে একটা মেঘ ধরিয়ে দিয়েছিল শ্রাবন্তিকা। কাজলের মত; কুয়াশার মত; নির্বোধ-মত একটা মেঘ। আমি মেঘটা ধরলাম। উল্টে পাল্টে দেখলাম। আঙ্গুল গলে গড়িয়ে পড়ছে দেখে — “সুন্দর হয়েছে” বলে আমি চুপচাপ মেঘটা  সাতটি তারার তিমিরে পুরে রেখেছিলাম। মেঘটা গুটিসুটি করে চুপচাপ বইয়ের ভাঁজে পড়ে ছিল। মেঘটা। শ্রাবন্তিকার দেয়া আরও হাজারও উপহারের মত মেঘটার কথাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আজ সন্ধ্যায় শেলফ খুলতে গিয়ে হঠাৎই শুনি প্রবল বর্জ্রপাত। জিউস আর থরের যুদ্ধে আমার কিছু করার নেই ভাবনায় — আমি শেলফটা খুলতেই চমকে উঠি। বইয়ের প্রতিটি তাক মরুভূমি আর প্রবল খরতাপে পুড়ে গেছে প্রতিটি অক্ষর। মরিচিকার ধোঁয়ার সাথে তাল মিলিয়ে ওপরে তাকাতেই দেখি — মেঘটা। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি; যেমন করে চোখ বন্ধ করে ফেলছি প্রতিদিন। আমি দেখতে চাই না — আমার সব গল্প পুড়ে গেছে। আমার সব বাক্য পুড়ে গেছে। আমার সব শব্দ পুড়ে গেছে। আমার সব অক্ষর পুড়ে গেছে। সেই পোড়াভূমিতে মরিচিকার ছায়া হয়ে আছে — মেঘটা। অভিমানের মত ছোট্ট মেঘটা — বইয়ের ভাঁজে যাকে নিমিষেই লুকিয়ে রাখা যেত; সে ঘৃণার মত বিস্তৃত হয়ে ঢেকে রেখেছে আমার সবখানি।...

শ্রাবন্তিকা চাইতো শ্রাবণ অঝোর মতন। ঠিক যতটায় আকাশ ভাঙ্গে, ঠিক যতটায় মেঘরা রাঙ্গে কালচে রকম। তাইতো বুঝি তার দু চোখে রয় লুকিয়ে পাঁপড়ি ভাঙ্গা অশ্রুপাবন অলিন্দটার রূপকথাদের সঙ্গে নিয়ে। মেঘের মত কালচে আঁকা তীব্র চোখে শ্রাবন্তিকা ঠায় তাকিয়ে থাকতো কেবল ঝুম অঝোরের বৃষ্টিশোকে। আর শ্রাবণের লাগতো ভাল ইলশে গুঁড়ি। দু'এক ফোঁটা দ্রোহী চুলে আর কতটা ঝাপটা মাতাল মেঘের নুঁড়ি। সেই ছেলেটা বোশেখ ঝড়ে যেমন শালিক খুব মাতাল আর ঝঞ্ঝাক্ষোভে ফের খুঁজে নেয় অলিন্দ এক। নিক খুঁজে নিক। অলিন্দটায় শ্রাবন্তিকার অশ্রুপাবন খেলতো মেঘ আর নীরের খেলা, ভাঙ্গতো আকাশ, ভাঙ্গত ভাঙ্গন, ভাঙ্গত আপন। দেখল শ্রাবণ ঢের হয়েছে বোশেখ খেলা। শ্রাবন্তিকার কালচে চোখে একটু করে বুলিয়ে দিল শরৎ ভেলা। ফোঁটায় ফোঁটায় খুবলে নিলো মেঘের নুঁড়ি। থর-বিথরে ছুড়ল সেসব শ্রাবন্তিকা চিনলো তখন ইলশেগুঁড়ি। যেমন করে মাতাল শালিক ছড়ায় ডানা, সেই শ্রাবণের নীলচে সে শার্ট থাকতে কোথাও অশ্রুপাবন ঝরতে মানা।

পারস্পরিক নৃশংশতা

অথচ আমাদের কতগুলান শব্দ জমা হয়া ছিলো।  বলা হইলো না। কিছুই বলা হইলো না। নিশিবকের ঠোঁটের রংটা দেখা হইলো না। কাঁঠাল পাতার শুকনা ঘ্রাণটা শোঁকা হইলো না। মাঘসংক্রান্তির কুয়াশা জড়ানো হইলো না। এক বিকেল নিস্তরঙ্গতায় ঘুমানো হইলো না। শ্যাওলা পড়া দেয়ালটার দুই পাশে যে দুইটা কুকুর রাজ্য আছে তাদের কাউরেই জাতিভেদের অপকারিতা বোঝানো হইলো না। অবশ্য আমরা নিজেরাই কখনও বুঝে উঠতে পারি নাই মানুষভেদের অপকারিতা। মানুষভেদের দীনতা। মানুষভেদের নৃশংসতা। আমরা পাশাপাশি হাঁটছি, ঘুরছি, ফিরছি। লোকলজ্জারে বুইড়া আঙ্গুল দেখায়া মাঝরাস্তায় চুমু খাইছি। তারপরও দুইজনের মাঝখানে রাইখা দিছি দুই নারিকেল গাছ পরিমাণ ব্যবধান। দুইজনের মাঝখানের ভেদাভেদ রাবার দিয়া মুইছা হৃদপিণ্ডটারে খাঁমচে আঁকড়ায় ধরার সাহস করি নাই আমরা কেউই। কখনই করি নাই। আমরা নিজেদের ওপর আরোপ কইরা রাখছি নৃশংস এক দৈন্য। অথচ আমাদের কতগুলান স্বপ্ন জমা হয়া ছিলো। দুঃস্বপ্ন ছাড়া তার কিছুই শোনা হইলো না। কিছুই দেখা হইলো না।

এক শালিকের নীল গল্প

 এক শালিকের গল্প ছিল নীলচে পাতায়।  আকাশ ছিল রাজ্যপট আর রাজত্ব তার মেঘ-কুয়াশায়।  ভবঘুরে ধূলো যেমন, পথরা যেমন, যেমন ঝরে ইলশেগুড়ি;  শালিকটাও উড়ত তেমন, ভিজত তেমন। গায় মাখাতো মেঘের কুঁড়ি।    আরেক ছিল পাথর-প্রাসাদ লাল পাহাড়ের চূড়ার ওপর।  উড়তে উড়তে একলা শালিক বসল এসে জানালার ’পর।  সেথায় ছিল মেঘবালিকা। রাজ্য তাহার অশ্রুর জল।  চার দেয়ালের নিরেট ঘরে থাকত নিয়ে আঁখি টলমল।  জানলাটা তার অলস সাথী। দিন কাটাতো ঠায় তাকিয়ে।  অনেকগুলো স্বপ্ন ছিল। কাটতো জীবন স্বপ্ন নিয়ে।  স্বপ্নগুলো স্বপ্ন হয়ে স্বপ্নেই রয়।  মেঘবালিকা, অশ্রুর জল, জানলাটা আর স্বপ্ন কেবল আর কেউ নয়।    অনেক উড়ে ভবঘুরে শালিক পাখি বসল এসে সেই জানালায়।  মেঘবালিকা দেখল তারে আসতে উড়ে নীল সীমানায়।  আদর করে ধান ছিটালো, বলল কথা, ঝরালো জল।  শালিক পাখি বুঝলনা বা বুঝল মেয়ের সব কোলাহল।  পালক দিয়ে মুছল তাহার অশ্রুজল আর দুঃখগাঁথা।  ইলশেগুড়ি কুড়িয়ে এনে দিল ধুয়ে মনের ব্যাথা।  মেঘবালিকা জল ঝরালো। শালিক দিল ছড়িয়ে ডানা।  অশ্রুজলে ভিজল ডানা। ভিজল হৃদয়। বুঝ...